এক যুগ আগে একটা পান্ডার আবির্ভাব ঘটেছিলো। সাদা-কালো, মোটা, সেই অলস পান্ডাটা বর্ণবাদ ভেঙে দিয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়েছিলো সেলুলয়েডের পর্দায়। চাইলে তার মতো করে নিজের অস্বস্তিগুলিও গুঁড়িয়ে দিতে পারেন, যেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনার নিজের উপর...

অ্যানিমেইটেড মুভি। অনেকেই কার্টুন বলে তাচ্ছিল্য করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। একটা সময়ে এই মুভিগুলোকে দর্শকেরা তেমন একটা পাত্তা দিতেন না। শিশুতোষ কনটেন্ট হিসেবে কেউ তেমন সিরিয়াসলিও নিতো না।

তবে কালের বিবর্তনে, শিশুদের সাথে এই মুভি জনরা মুগ্ধ করেছে সব বয়সী দর্শকদের। এটা এমনই এক জনরা যেখানে প্রায় প্রত্যেকটা মুভিতেই হাস্যরসের ছলে কোনো না কোনোভাবে জীবনবোধ তুলে ধরা হয়। দেখা শেষে যে তৃপ্তিটা পাওয়া যায়, মূলত সেটার লোভেই সিনেমা দেখা।

চলচ্চিত্রে এই অ্যানিমেশনের ইতিহাস শতবর্ষেরও বেশি। ১৯০৬ সালে কার্টুনিস্ট জে. স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন চকবোর্ডের স্লাইডের মাধ্যমে একটা কার্টুন এনিমেশন তৈরি করেন। সেটাই ইতিহাসের প্রথম। সেই থেকে শুরু। কতশত অ্যানিমেইটেড মুভি নির্মিত হয়েছে, যা আমাদের হাসিয়েছে, কখনো কাঁদিয়েছে, কখনো বা ভুলিয়েছে যাপিত জীবনের যন্ত্রণা।

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৯১ সালের বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট অ্যানিমেইটেড মুভিটা সেবার অস্কারে সেরা চলচ্চিত্রের মনোয়োন পর্যন্ত পেয়েছিলো। তখন অ্যানিমেশনের নিজের ক্যাটাগরিই ছিলো না সেখানে। ২০০২ সালে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের গুরুত্ব স্বীকার করে নেয় একাডেমি। সেবছর থেকেই ঐ ক্যাটাগরিতে অস্কার দেয়া শুরু হয়।

এরপর অবশ্য আরো দুইবার ঘটেছিলো একই ঘটনা। ২০০৮ সালে ‘আপ’ এবং ২০১০ সালে ‘টয় স্টোরি থ্রি’, অ্যানিমেইটেড মুভি হওয়া সত্ত্বেও ‘বেস্ট পিকচার’ ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পায়। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ঐ ক্যাটাগরি জয় করতে পারেনি।

খেয়াল করলে দেখবেন, আত্মকেন্দ্রিক সাংঘর্ষিক চরিত্রায়ণে বেশ কিছু দারুণ অ্যানিমেশন নির্মিত হয়েছে। রান্নাঘরের বড় শত্রু ইঁদুর, অথচ সেই ইঁদুরই কিনা সিদ্ধহস্ত বাবুর্চি- ফলাফল দারুণ এক সিনেমা ‘র‌্যাটাটুই'। জনমানব শূন্য পৃথিবীতে টিকে থাকা এক রোবোট, যার মাঝে রয়েছে মানবিক গুনাবলী, যে ভালোবাসার জন্য মহাকাশ পাড়ি দিতে পারে- ফলাফল দারুণ আরেকটি সিনেমা ‘ওয়াল ই’।

এমনই আরেক সাংঘর্ষিক প্লটে নির্মিত কুং ফু পান্ডা। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার গল্পটা একটা অলস পান্ডার। বড়সড় নাদুসনুদুস পান্ডা। নাম তার পো। হাঁটাচলা, কথাবার্তা খুবই কৌতুকপূর্ণ। অথচ সে একজন কুংফু যোদ্ধা হতে চায়। এটা যদি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতো তবে আজকের এই লেখাটা লেখাই হতো না। এই গল্পটার সাথে মিশে আছে আত্ম-অনুসন্ধান। মানে নিজেকে খুঁজে বেড়ানো। অস্তিত্বের তাড়নায় নিজেকেই তাড়া করা। সেই চিরকালীন আত্মদ্বন্দ।

উপভোগ করার মতো কোনো সিনেমায় দর্শক মনের খোরাক বা বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত রসদ থাকে। কিন্তু যে সিনেমায় সেই এলিমেন্টগুলোর সাথে জীবনবোধটাও মিশে থাকে, সেটাকেই আমরা অসাধরাণের তালিকায় স্থান দিই। কুংফু পান্ডা এমনি এক কম্বিনেশনে বানানো।

বক্সঅফিসে ব্যবসাসফল কুং ফু পান্ডা ফ্র্যাঞ্চাইজিটি মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগটা সাজানো হয়েছে নিজেকে খুঁজে পাওয়া নিয়ে, দ্বিতীয়টায় মানসিক প্রশান্তি, তৃতীয়টায় প্রথম দুইটা থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দেয়া। প্রথম দুইটা অস্কারে নমিনেশন পায়। ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয় পার্টটা সবচাইতে বেশি উপভোগ করেছি, দারুণ অনুপ্রেরণামূলকও বটে। গুগল করলে কুং ফু পান্ডার টিভি সিরিজ সম্পর্কেও জানতে পারবেন।

এই সিনেমার মূল প্রাণ পান্ডা পো এর চরিত্রে কন্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা জ্যাক ব্ল্যাক, তার সংলাপ বলার ধরণ এতোটাই দারুণ ছিলো, যে আপনার মনে হবে পান্ডারা যদি কথা বলতে পারতো, তবে হয়তো এভাবেই বলতো। মাস্টার শিফু চরিত্রে ডাস্টিন হফম্যান, টাইগ্রেস চরিত্রে এঞ্জেলিনা জোলি, মাংকি চরিত্রে জ্যাকি চ্যান, ম্যান্টিস চরিত্রে সেথ রোগেন, ভাইপার চরিত্রে লুসি লিউ।

প্রথম পর্বের ভিলেন টাই লাং চরিত্রে ইয়ান ম্যাকশেন, দ্বিতীয় পর্বে ভিলেন শেন চরিত্রে গ্যারি ওল্ডম্যান, তৃতীয় পর্বের ভিলেন চরিত্রে জে কে সিমন্স। এবং উল্লেখযোগ্য পার্শ্বচরিত্র পো এর বাবা মিস্টার পিং চরিত্রে জেমস ওং, সুথসেয়ার চরিত্রে বন্ডগার্ল মিশেল ইয়ো, মেই মেই চরিত্রে কেড হাডসন কন্ঠ দিয়েছেন।

এবং যার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়, মাস্টার উগুয়ে। যার চরিত্রে কন্ঠ মিলিয়েছেন রান্ডাল দুক কিম। উগুয়ের কথা বলতে গেলে স্ট্রেইট বলতে হয়— ওয়ান অফ দ্য কুলেস্ট ক্যারেক্টার আই হ্যাভ এভার সিন। দ্যাটস ইট।

আসলে এই সিনেমায় প্রতিটা চরিত্রে ভয়েস দেয়া আর্টিস্টরা তাদের সেরাটা দিয়েছেন। গ্রেট টিম এফোর্ট। এতে পুরো সিনেমাটাই বেশ প্রাণবন্ত হয়েছে। সাথে ছিলো হ্যান্স জিমারের মিউজিক কম্পজিশন। পুরো ফ্র্যাঞ্চাইজির অডিও এক্সপেরিয়েন্স ছিলো একদম টপ নচ।

কুং ফু পান্ডার মূল আকর্ষন হচ্ছে এর হিউমারাস ডায়লগ। যা কখনো হাসাবে, কখনো ইমোশনাল করে দিবে, কখনোবা ভাবিয়ে তুলবে, এতোটাই শক্তিশালী।

  • Yesterday is history. Tomorrow is a mystery. But today is a gift. That is why it is called the present.
  • There are no accidents.

  • One often meets his destiny on the road he takes to avoid it.

  • Your story may not have a happy beginning, but that doesn't make you who you are. It is the rest of your story, who you choose to be. You must believe.

  • You gotta let go of that stuff from the past, cause it just doesn’t matter. The only thing that matters is what you choose to be now.

  • If you only do what you can do, you will never be more than who you are.

  • There is no secret ingredient. To make something special you just have to believe it's special.

  • The more you take, The less you have.

  • Your mind is like the water, my friend. When it is agitated, it becomes difficult to see. But if you allow it to settle, the answer becomes clear.

এগুলো ছাড়াও বেশ কিছু দুর্দান্ত ডায়লগ রয়েছে পুরো ‍ফ্র্যাঞ্চাইজিতে, যা বেশ অনুপ্রেরণামূলক ও উপভোগ্য। শুরুতেই বলেছি এটা ডিপ্রেসনের মহাঔষধ, আসলে কোনো সিনেমা দেখে ডিপ্রেশন পুরোপুরি দূর হয় না, বরং কিছুটা প্রশান্তি আসতে পারে। তবে যে তৃপ্তিটা আসে সেটা হয়তো ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধে স্বস্তি ও শক্তি যোগায়।

একটা সাদা-কালো, মোটা, অলস পান্ডা যেভাবে বর্ণবাদ ভেঙে দেয়, আপনি চাইলে আপনার অস্বস্তিও গুঁড়িয়ে দিয়ে পারে। এটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনার উপর, আপনি কিভাবে নিচ্ছেন এটাকে। যদি সিনেমার সাথে তার মেটাফোরগুলোও ধরতে পারেন, তবে দেখা শেষে হয়তো উপলব্ধি হতে পারে যে... I’m not a big fat panda, I am THE big fat panda… I figured it out, SKIDOOSH!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা