অমেরুদণ্ডী প্রশাসন, অহেতুক সমালোচনা ও বিন্দুকে সিন্ধু বানানোর গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
স্লিভলেস পোষাক বা আরব দেশের জোব্বা, দুটোই যার যার চয়েজ, সেটা নিয়ে সমালোচনার অধিকার আপনাকে দেয়া হয়নি।
কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ২০১৫ ব্যাচের শেষ ক্লাস ছিল কয়েকদিন আগে। সেই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা মজার কিছু করবে বলেই ভেবে রেখেছিল। এর আগে একটা ব্যাচের সবাই শেষ ক্লাসের দিন দক্ষিণ ভারতীয় পোষাক পরে ক্লাসে এসেছিল, ছেলেরা শার্ট-লুঙ্গি, মেয়েরা শাড়ি। ২০১৫ ব্যাচের ছাত্ররাও সেরকম ভাবনা থেকেই ছেলেরা অ্যারাবিয়ান জোব্বা আর মেয়েরা শাড়ি পরে ক্লাস করতে এসেছিলেন।
চার বছর ধরে যে ক্যাম্পাসটাকে তারা আগলে রেখেছিলেন, তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল যেই জায়গাগুলো, সেখানে গিয়ে তারা ছবি তুলেছেন। তবে সেই ছবিগুলো যে আপামর বাঙালির আলোচনার খোরাকে পরিণত হবে, সেটা বোধহয় তাদের কল্পনাতেও ছিল না। সামান্য একটা পাঞ্জাবী-জোব্বা পরা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ডটাই না ঘটে চলেছে! টেলিভিশনের টক-শো থেকে পত্রিকার পাতা, সর্বত্র জায়গা করে নিয়েছে এই ঘটনা!
কুয়েট প্রশাসন একটা প্রজ্ঞাপন জারী করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টারের স্বাক্ষর সংবলিত সেই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- 'খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে কিছু নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন। এই পোশাক বাংলাদেশের সংস্কৃতিরও পরিপন্থী।'
লেখাটা পড়ে একবার মাথা চুলকে নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অফিসের লোকজনের আজকাল প্রচুর অবসর সময়। সারাদিন বসে বসে মাছি মারার চেয়ে এমন উদ্ভট প্রজ্ঞাপন জারি করাটাকেই হয়তো প্রোডাক্টিভ হিসেবে দেখছেন তারা। অবশ্য, পুরো বাঙালি জাতিরই তো করার মতো কাজ আছে বলে মনে হচ্ছে না। নইলে র্যাগ ডে-তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মজা করে কী পোষাক পরেছে, সেটা নিয়ে দেশজুড়ে এত হইচই হবার তো কথা নয়!
কিন্ত হইচই হচ্ছে, এবং হইচই করছেন প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষজন, যারা কীনা পোষাকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, কথায় কথায় ব্যক্তিস্বাধীনতার বুলি কপচান। তাদের মতে, কুয়েট ২০১৫ ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের এই পাঞ্জাবী-জোব্বা পরাটা কোনভাবেই বাঙালীয়ানার সঙ্গে যায় না, এটা নাকী বাঙালী সংস্কৃতিকে অপমান! কথাটা শুনে মাননীয় স্পিকার হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। অকর্মন্য একটা জাতি, করার মতো কাজ নেই, ভাবার মতো বিষয় নেই, তাই ঠুনকো একটা জিনিসকে তিল থেকে তালে পরিণত করার কী আপ্রাণ বাসনা আমাদের!
একাত্তর টিভিতে এক উপস্থাপিকাকে দেখলাম লাইভ সেশনে ছাত্রদের প্রশ্ন করছেন, 'আপনারা আরব দেশের পোষাক পরে কেন র্যাগ ডে পালন করতে গেলেন, বাংলাদেশী পোশাক পরে কী সেটা পালন করা যেতো না?' অথচ ভদ্রমহিলা নিজেই তখন ইউরোপিয়ানদের মতো স্যুটেড ব্যুটেড হয়ে আছেন! হিপোক্রেসির তো একটা সীমা আছে রে ভাই! এই ছেলেগুলো গেঞ্জি-লুঙ্গি পরে ক্লাস করতে গেলে কেউ আলোচনা করতো না, স্যুট পরে ক্লাস করতে গেলে কেউ ফিরেও দেখতো না। সমস্যা শুধু আরব পোষাকে?
একদল বলছেন, জঙ্গী হবার এটাই নাকী প্রথম ধাপ! হলি আর্টিজানের হামলাকারী নিব্রাসদের পরনেও এমন জোব্বা ছিল! বাঙালির লজিকের গতিবেগ আলোর চেয়েও বেশি, কখন সেটা মর্ত্যে থাকবে আর কখন যে মঙ্গলে চলে যাবে, বোঝার কোন উপায় নেই। আরব দেশের জোব্বা পরার সাথে জঙ্গী হবার সম্ভাবনা ঠিক ততটাই, স্লিভলেস জামা পরলে 'চরিত্রহীন' হবার সম্ভাবনা যতোটা। সারা বছর মানুষকে পোষাক দিয়ে জাজ করার বিরুদ্ধে কথা বলে আসা মানুষগুলোর এমন চেহারা দেখে সত্যিই অবাক লাগছে।
আরও বেশি অবাক হয়েছি কুয়েট প্রশাসনের অমেরুদণ্ডী আচরণে। পুরো বিষয়টাতে সিএসই-২০১৫ ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের কোন দোষ ছিল না, তারা সরল মনেই জোব্বা পরে ক্লাস করেছে, ছবি তুলে দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন অথচ নানামুখী সমালোচনা দেখে কুয়েট প্রশাসন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে পোশাকের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ছাত্রকল্যাণ দফতর, সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্ট বা বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করতে হবে- এই মর্মে ফতোয়াও জারী করেছে! একজন ছাত্র কী পোষাক পরবে, এটার জন্যেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে?
এই লেখা এক শ্রেনীর মানুষের খুব ভালো লাগবে, তারা কমেন্টে এসে সহমত জানিয়ে যাবে, লেখার প্রশংসা করবে। অথচ কাল যদি রাস্তায় একটা মেয়ে টাইটফিট বা স্লিভলেস জামা পরে বের হয়, তাকে নিয়ে কটুকথা বলতে এরা এক সেকেন্ড দেরীও করবে না, উল্টো গর্বের সাথে দাবী করবে, নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে এরকম বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করা ঠিক না। মাথায় অ্যানাকোন্ডার অণ্ডকোষ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এসব ফতোয়াবাজ ধর্মান্ধ লোকজনের সঙ্গে প্রগতিশীলতার কথা বলা মানুষগুলো এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন, এটা মানতেই কষ্ট হচ্ছে।
স্লিভলেস পোষাক বা আরব দেশের জোব্বা, দুটোই যার যার চয়েজ, সেটা নিয়ে সমালোচনার অধিকার আপনাকে দেয়া হয়নি। মানুষের আলোচনা-সমালোচনা সবকিছু হোক কাজের ওপরে, তার পোষাকের ওপরে নয়...