বিটিভিতে আবারও ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
করোনাভাইরাসের কারণে থমকে গেছে শ্যুটিং। সবাই একপ্রকার গৃহবন্দী। এমন সময়ে বিটিভি জানালো দারুণ এক খবর। আশি ও নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত দুটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’ পুনরায় প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চ্যানেলটি।
আগামী ৬ এপ্রিল থেকে এগুলো বিটিভিতে পুনঃপ্রচার হবে বলে জানান চ্যানেলটির মহাপরিচালক এস.এম. হারুন-অর-রশীদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনার এই সময় মানুষ যেন বাসায় ভালোভাবে সময় কাটাতে পারেন, এ জন্য পুরনো দুটি নাটক প্রচারের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া এখন চাইলেইও তো শুটিং করতে পারছি না। শিল্পীরাও আসবেন না। আর আসার মতো সময়ও নয় এখন। সব মিলিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেয়া।’
কবে ও কখন এগুলো প্রচার হবে, এই প্রসঙ্গে মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘৬ এপ্রিল থেকে প্রচার শুরু করার পরিকল্পনা। দুটি নাটকই একই সঙ্গে শুরু হবে। অনেক পুরো জিনিস তো, এগুলো চাইলেই তো সঙ্গে সঙ্গে প্রচার করতে পারি না। কিছুটা প্রস্তুতিও নিতে হয়। এটা নিতে যতটুকু সময় লাগে, এটুকুই। তবে প্রচারের সময় এখনও ঠিক করা হয়নি।’
কোথাও কেউ নেই
১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ‘কোথাও কেউ নেই’। এদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় নাটক ধরা হয় এটা। যার মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় ‘বাকের ভাই’। এ চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। এতে মুনা সুবর্ণা মুস্তাফা, বদি আবদুল কাদের, মজনু লুৎফর রহমান জর্জ, মতি মাহফুজ আহমেদ, উকিল ভূমিকায় হুমায়ুন ফরীদিও তুমুল সাড়া পান।
বাকের ভাইয়ের মুখের সংলাপগুলো তখন ঘুরতো তরুণদের মুখে মুখে। তার মতো গলায় চেন ঝুলিয়ে, শার্টের বোতাম খোলা রেখে ঘোরার একটা স্টাইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার দোকানে দোকানে বাজতো বাকের ভাইয়ের প্রিয় গান- 'হাওয়া মে উড়তা যায়ে...'। নাটকের শেষদিকে যখন মিথ্যে মামলায় বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলো, তখনই সবচেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনাটা ঘটলো। প্রিয় চরিত্রের ফাঁসি হয়ে যাবে, এটা মেনে নিতে না পেরে রাস্তায় নেমে এলো সাধারণ মানুষ। হুমায়ূন আহমেদের শহীদুল্লাহ হলের বাড়িতে পাঠানো হলো উড়ো চিঠি, প্রেসক্লাবের সামনে হলো মানববন্ধন। ঢাকার বাইরেও মিছিল বের হলো, স্লোগান উঠলো- 'বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালী জবাব চাই', 'বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে...' অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিটিভিতে ফোন গেল। প্রযোজক বরকতউল্লাহ খানের কাছে অনুরোধ করা হলো- ‘হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, নাটকের শেষে বাকেরকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা...'। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ রাজি হননি।
পরের সপ্তাহে, সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে শেষ পর্বটা প্রচারিত হলো। সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার অবস্থা থমথমে, জেলা শহর আর মফস্বলের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ, ভূতুড়ে রূপ নিয়েছে সেগুলো, যেন কারফিউ চলছে! হুমায়ূন আহমেদ নিজের বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছেন আবদুল কাদেরকে নিয়ে, কাদেরের বাসায় হামলা হয়েছে এর আগে, প্রাণভয়ে তিনি থানায় জিডি করেছেন। নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।
এরপরের গল্পটা তারা জানেন, নব্বইয়ের সেই গুমোট রাতে যারা বিটিভির পর্দায় কোথাও কেউ নেই নাটকের শেষ পর্বটা দেখেছিলেন, যারা সাক্ষী হয়েছিলেন মুনার কান্নার, অসীম শূন্যতার এক বোবা অনুভূতি তাদের ঘিরে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। ভোররাতে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মুনা কাঁদিয়েছেন হাজারো দর্শককে। আপনি আসামীর কি হন?- জেলারের এই প্রশ্নের প্রশ্নের জবাবে মুনা যখন বলছেন, 'আমি ওর কেউ না'- তখন চোখের জল আটকে রাখতে পেরেছেন হাতেগোনা কয়েকজন দর্শকই।
বহুব্রীহি
অন্যদিকে পারিবারিক গল্পে ‘বহুব্রীহি’ও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে বিটিভিতে প্রচারিত হয় এটি। সামরিক শাসনের সেই সময়ে এ ধারাবাহিকে টিয়া পাখির মুখে বলা ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি জনপ্রিয় হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণার প্রতীক হিসেবে এটি আলোচিত হয়েছিল। এছাড়া আরও দুইটি সংলাপ ভীষণ জনপ্রিয় হয়- 'আপনি হলেন গিয়ে বটবৃক্ষ' এবং 'বহিষ্কার হও'।
মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা সোবাহান সাহেব সম্প্রতি উকালতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তার দুই মেয়ে বিলু ও মিলি এবং স্ত্রী মিনুকে নিয়ে সুখের সংসার। আর আছে ফরিদ মামা আর কাজের লোক রহিমার মা ও কাদের। হঠাৎ তিনি দেশের ইলিশ সংকট নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। নদীতে জাটকা ধরা পড়ছে ও বাজারে ইলিশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তিনি ভাবতে লাগেন ইলিশ অদূর ভবিষ্যতে একটা জাদুঘরের জিনিস হবে। অনেক চিন্তা ভাবনা পর তিনি এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে গিয়ে সুচিন্তিত মতামত ও যুক্তি উত্থাপন করেন যে বাঙালিকে এক বছরের জন্য ইলিশ মাছ খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। বাঙালির ওই এক বছরের সংযম থেকে বহু বছরের ইলিশ সংস্থান হয়ে যাবে। এভাবেই এগিয়ে যায় গল্প। এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, আফজাল হোসেন, লুৎফরনাহার লতা, লাকী ইনাম, আবুল খায়ের, আফজাল শরীফসহ আরো অনেকে।
হুমায়ূন বিশ্বাস করেন লেখকের স্বাধীনতায়, পরিচালকের স্বাধীনতায়। সেই জায়গা থেকে তিনি ভেবে রেখেছেন বাকেরের ফাঁসির কথা, মানুষের দাবীর মুখে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন না। সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে কোথাও কেউ নেই এর শেষ পর্ব প্রচারিত হবার কথা, ঢাকা শহরে এর আগেই অবশ্য গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। আগের পর্বে বদি (আবদুল কাদের) কুত্তাওয়ালীর হুমকিতে বাকেরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজী হয়ে গেছে। ১৪ তারিখে শেষ পর্ব প্রচারিত হলো না, কারণ সেই পর্বের শুটিংই শেষ হয়নি! পরে হুমায়ূন আহমেদ অজানা এক লোকেশনে শেষ করলেন শুটিং, একদম গোপনে।