কলকাতার ট্রাম: এক পয়সার আন্দোলন ও জীবনানন্দের মৃত্যু!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কলকাতার ট্রাম ১৪৭ বছর ধরে কলকাতাবাসীকে দেখাচ্ছে বিভিন্ন রকমের ভেলকি। ট্রামের এক পয়সার আন্দোলনে পুরো দেশ অচল হওয়াসহ এই ট্রামের নীচেই হয়েছে জীবনানন্দের রহস্যজনক মৃত্যু। ঘোড়ায় টানা ট্রাম ও মানুষে টানা ট্রামের পরে কিভাবে এলো বর্তমানের ট্রাম, সে ইতিহাস জানলে চমকে উঠবেন সবাই!
পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক যারা আছেন, তারা যখন কলকাতাকে উপজীব্য করে কোনো উপন্যাস লেখেন, সে উপন্যাসে অবধারিতভাবেই একটি অনুষঙ্গ বারবার চলে আসে। সেটি হচ্ছে, ট্রাম। অবশ্য আসবে নাই বা কেন, বেশ অনেকদিন ধরেই তো জোব চার্নকের এই শহরটিকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে যান্ত্রিক এই সরীসৃপ। তাই চাইলেও অথবা না চাইলেও সে চলেই আসে চারমিনার-জ্বলা আড্ডার মাঝখানটিতে, বইয়ের পৃষ্ঠায়-কালির অক্ষরে। তাছাড়া মাঝেমধ্যে ট্রাম অন্যভাবেও চলে এসেছে বিতর্কের পোডিয়ামে। ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বৃদ্ধির প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ দেখেছে এ শহর, সে তো ইতিহাসেই বিরল। তাছাড়া, দু থোকা ডাব নিয়ে ট্রামের ধাক্কায় নিহত হয়ে জীবনানন্দ দাশও তো তাঁর মত করেই ট্রামের হোলসেল প্রমোশন করে দিয়ে গিয়েছেন। তা কেমন আছে সেদিনের সেই সম্ভ্রমের প্রতীক ট্রাম ? মান্না দে'র গানের মতন 'খুব জানতে ইচ্ছে করে।' আমাদেরও। মধ্যদুপুরে শালপাতার ঠোঙ্গায় দশ টাকার ঘুগনি খতম করে উঠে পড়া যাক জনাকীর্ণ এক ট্রামে৷ ঘুরে বেড়ানো যাক শহরতলীতে। কী, উঠবেন তো আমার সাথে ট্রামে? চলুন যেতে যেতেই কথা বলি
কলকাতায় একেবারে প্রথমে চালু হয়েছিলো ঘোড়ায় টানা ট্রাম। এখন যে ইলেকট্রিক অথবা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রাম আমরা দেখি, তার ছিটেফোঁটাও ছিলোনা প্রথমদিকে। শিয়ালদহ আর আর্মেনিয়াম স্ট্রীটের মাঝখানে আড়াই কিলোমিটার জুড়ে শুরু হয় ট্রামের যাত্রা। সমস্যা হলো, ঘোড়া দিয়ে আর যাই টানানো যাক, ট্রাম টানানো বেশ মুশকিল। যাত্রীরাও প্রথম প্রথম উঠতো না এই ট্রামে। ভয় পেতো। তাই বছর যেতে না যেতেই ট্রামের চাকা ঘোরা বন্ধ হয়ে গেলো। এটা ১৮৭৩ সালের ঘটনা।
এই ঘটনার সাত বছর পরে অর্থাৎ ১৮৮০ সালের দিকে 'সিটিসি' অর্থাৎ 'ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি' গঠিত হয়। যাদের কাজ ছিলো কলকাতার ট্রাম ব্যবস্থার সুষ্ঠু বন্টন ও কাজকর্মের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা।আবার সেই শিয়ালদহ ও আর্মেনিয়াম স্ট্রীট থেকেই যাত্রা শুরু করলো ট্রাম। এর আগে রাস্তা খুঁড়ে ট্রামের জন্যে আলাদা মিটারগেজ ট্রাম লাইন বসানো হলো। ঘোড়ায় টানা ট্রাম তো ব্যর্থ। কর্তৃপক্ষ এরপর যেটা করলেন সেটা খুবই বর্বর এক কাজ। মানুষ দিয়ে ট্রাম চালানো শুরু করলেন তারা। সেটাও বেশিদিন কাজ করলো না। তবে কর্তৃপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার আগেই বাষ্পচালিত ইঞ্জিন চলে আসে বিদেশ থেকে। সেই ইঞ্জিন ট্রামে লাগানোর পরপরেই মোটামুটি ট্রামের ভাবগাম্ভীর্যই বদলে যায়। মানুষজনও সাহস করে উঠতে শুরু করে ট্রামে। ব্রিটিশরাও তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে ট্রামের ব্যাপক বিজ্ঞাপন করে। ট্রাম হয়ে ওঠে কলকাতাবাসীর কাছে এক বিস্ময় ও প্রয়োজনীয় বাহন। আস্তে আস্তে ট্রামের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৮৮২ এর শেষদিকে এসে কলকাতার উনিশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চালু হয় ট্রাম৷
এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ট্রামে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। ১৯০২ সালের দিকে ট্রামে যুক্ত হয় ইলেক্ট্রিক লাইন। ইলেক্ট্রিক ট্রাম বেশ জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে তখন। কলকাতার উদার বুকে জমতে থাকে কালো কালো ইলেকট্রিক তার, গোটা শহর ছেয়ে যায় ট্রামের দেহে।
এরপর ডামাডোল। টুকরো হলো মানচিত্র। র্যাডক্লিফের বদৌলতে কোলকাতা এলো ভারতের ঘরে। লালমুখো ব্রিটিশরা ছাড়লো ভারত। তবে ব্রিটিশরা চলে গেলেও ট্রাম নিয়ন্ত্রণের যে ক্ষমতা সেটা তারা ছাড়লোনা। তবে তাও বেশিদিনের জন্যে নয়। আইন করে ট্রামের ক্ষমতা বুঝে নিলো ভারত সরকার। মানচিত্রের পালাবদল বা ক্ষমতার বহু চলকের লুকোচুরি, ট্রাম কিন্তু রইলো ঠিক আগেরই মতন। ঘন্টা বাজিয়ে, ধ্যানী বুদ্ধের মতন প্রশান্ত ভঙ্গিতে, মন্থর গতিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো পুরো কলকাতায়।
স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতার অবস্থা নাজুক ছিলো। সদ্যোজাত যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই এটি বেশ স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অর্থনীতির বেহাল দশা, বেকারত্ব প্রবল, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বাড়ছে ক্রমাগত। সবমিলিয়ে চাপ সামলাতে পারছিলো না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এরকমই এক সময়ে দেশের অর্থনীতি একটুখানি চাঙ্গা করার জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া এক পয়সা বাড়াবার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, ট্রামে তখন দুই রকম ক্লাস ছিলো। এক- ফার্স্ট ক্লাস। টিকেটের দাম একটু বেশি ছিলো। সীট একটু আরামদায়ক। দুই- সেকেন্ড ক্লাস। সস্তায় প্রায় অধিকাংশ কলকাতাবাসীই এই সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করতেন।
সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি সাধারণ মানুষজন। বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন তারা, বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী এসে আন্দোলনের ভস্মে ঘি ঢালেন। গঠিত হয় প্রতিরোধ কমিটি। এখান থেকে সিদ্ধান্ত হয়, কেউ ট্রামের বেশি ভাড়া দেবে না। মিছিল, মিটিং, শ্লোগান, পিকেটিং সব হয় এই ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে।
যেদিন থেকে ভাড়া বৃদ্ধি কার্যকর করার কথা, সেদিন প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আগের ভাড়াই দেয়া শুরু করেন সাধারণ মানুষ। ট্রামের কন্ডাক্টর, ড্রাইভারেরা সে টাকা নিতে না চাইলে বিনাপয়সায় ভ্রমণ করেন মানুষজন। মারামারি, হাতাহাতিও হয় বিভিন্ন জায়গায়।
বিষয়টা জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তিনি সবাইকে সাবধান করে দেন। বলেন, প্রয়োজনে গ্রেফতারও করা হবে মানুষকে, যদি কেউ ট্রামের বৃদ্ধিকৃত ভাড়া না দেন। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মানুষ আরো খেপে যায়। পিকেটিং, ভাংচুর, অবরোধ চলতে থাকে। পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয় সাধারণ মানুষের। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, আইন অমান্য আর পিকেটিং করার দায়ে প্রতিরোধ কমিটির নেতা জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ, সুবোধ ব্যানার্জীসহ ছয়শ' লোককে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষ আরো মারমুখী হয়। হরতাল ডাকা হয়। ট্রামের স্বাভাবিক কাজকর্মও বন্ধ হয়ে যায় সাময়িক সময়ের জন্যে। শুধু ট্রামই বা কেন, হরতালের কারণে পুরো কলকাতাই অচল হয়ে যায়। প্রতিরোধ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, ট্রাম বর্জন করবে তারা। সরকারের তরফ থেকে ১৪৪ ধারা ডাকা হয়। যথারীতি মানুষজন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গে।
প্রতিরোধ কমিটি সভা ডাকে। সে সভায় সাংবাদিককের সাথে মানুষজনের সংঘর্ষ হয়। সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরকার চাপের মুখে জ্যোতি বসু সহ বাকিদের মুক্তি দেন। ১৪৪ ধারাও অপসারণ করেন। ট্রামের ভাড়া আর বাড়ানো সম্ভব হয়নি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে। ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ, এরকম ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল হয়ে থেকে যায়।
ট্রাম এভাবেই বিভিন্ন সময়ে জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন ইতিহাসের। জীবনানন্দের দাশের মৃত্যু যেমন। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও পুরো ঘটনাটিই হয়ে আছে রেডিও মিরচি'র 'সানডে সাসপেন্স।' স্বাভাবিকভাবেই ট্রামের গতি একটু শ্লথ হয়। ট্রামের একশো সাতচল্লিশ বছরের ইতিহাসে জীবনানন্দ দাশই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রামের নীচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথবা কেউ কেউ বলেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে যেটাই হোক না কেন, দুই হাতে দুই থোকা ডাব, সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্রামলাইন পার হওয়া মানুষটি ট্রামের ধাক্কায় লুটিয়ে পড়েন নীচে। ট্রামের ক্যাচারে পিষে যায় শরীর, ভেঙে যায় কণ্ঠা, উরু আর পাজরের হাঁড়। যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে শেষমেশ ২২শে অক্টোবর পৃথিবী থেকেই বিদায় নেন 'আবার আসিবো ফিরে' বলা 'রূপসী বাংলা'র কবি। ধূসর পান্ডুলিপি ফেরত নেয়ার ফুরসত তিনি পাবেন কী না, সে নিয়ে আমরা আর না ভাবি বরং।
ঘটনা, দুর্ঘটনার 'মেরি গো রাউন্ড' এ সওয়ার হয়ে তাই আজও প্রাসঙ্গিক কলকাতার ট্রাম। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু যুক্তও হয়েছে ট্রামে। শীতাতপনিয়ন্ত্রক হয়েছে কক্ষগুলো, বিলাস-প্রসাধনী যুক্ত হয়েছে কামরায় কামরায়, আধুনিক বহু প্রযুক্তির আনাগোনাও ঘটেছে এখানে। সে সাথে এটাও বলার, অনেক দ্রুতগামী বাহন এসেছে এখন কলকাতায়। মেট্রোরেল এসেছে। বাস, ট্রেন তো আগে থেকেই ছিলো। এয়ার কন্ডিশন্ড রেস্তোরাঁয় হালকা আঁচে বিটোভেনের সিম্ফোনি শুনতে শুনতে চা খাওয়া গেলেও যেমন গলির মোড়ের মাটির ভাড়ের চা টানে বেশি, সেভাবেই দ্রুতগামী চটকদার বহু বাহনের ভীড়ে আজও বাঙ্গালীকে নষ্টালজিক করে প্রাচীন রঙচটা এ বাহন। তাছাড়া নষ্টালজিক করবে নাই বা কেন, সময়ের পরিক্রমায় এই ট্রাম যে বাংলার ইতিহাসের এক বড়সড় অংশই হয়ে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে শৈশব-কৈশোরের নরম পেলব স্মৃতি হয়ে। অতীতেরই এক বড়সড় অংশ হয়ে রয়েছে এ ধাতব বাহন।
আর অতীতকে এত সহজে ভোলা যায় না। সেটা সম্ভবও না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন