তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে বিদ্যানন্দকে আজ অসহায়ভাবে বলতে হচ্ছে, আমাদের ৯০% ভলান্টিয়ার মুসলমান... এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি? মানুষের জন্যে কাজ করার এই কি প্রতিদান?
আমরা আরও একবার হেরে গেলাম ধর্মান্ধদের নোংরামির কাছে। হেরে গেল মানবতা, জিতে গেল উন্নাসিক আচরণ, বিবেক-বুদ্ধিহীন কিছু মানুষের জয় হলো। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন- করোনার এই ক্রান্তিকালে যে প্রতিষ্ঠানটা সবার আগে এগিয়ে এসে সবচেয়ে বেশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দুধের শিশু থেকে রাস্তার অভুক্ত কুকুর- কেউ যাদের ভালোবাসার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত থাকছে না, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ থেকে অনেকটা অভিমান করেই সরে যাচ্ছেন কিশোর কুমার দাস, যিনি বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা, যার হাত ধরে মানবসেবার এই মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। তার অপরাধ কি শুনবেন? তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী, একারণেই তাকে নিয়ে উঠেছে বিতর্ক, চাপা অভিমান বুকে নিয়ে বিদ্যানন্দকে বিতর্কের বাইরে রাখতে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ থেকে সরে যাচ্ছেন তিনি!
গত দুই মাস ধরে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন আর এর স্বেচ্ছাসেবকরা দিনরাত এক করে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই অকাতরে দান করছে বিদ্যানন্দে, সেই টাকায় বাজার করে, ত্রাণসামগ্রী কিনে সেগুলো বিতরণ করছে বিদ্যানন্দ। কোথাও সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া হচ্ছে, কোথাও আবার কোস্ট গার্ডের। কোটি কোটি টাকা বাকী পড়ছে কখনও, আবার কারো দানে সেটা শোধও হয়ে যাচ্ছে।
শুরু থেকেই ফেসবুকে একটা গোষ্ঠী বিদ্যানন্দের নামে অপপ্রচারের নেশায় মেতেছিল। তাদের অভিযোগ- বিদ্যানন্দ একটা হিন্দুয়ানি নাম, এর প্রতিষ্ঠাতাও হিন্দু, কাজেই এসব দানের নাটক করে লাভ নেই। বিদ্যানন্দের ত্রাণ বিতরণের খবরের নিচে 'যতোই দান করো, বেহেশত তো পাবা না' টাইপের কমেন্ট চোখে পড়েছে অজস্র। যেন বেহেশতের দারওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে কমেন্টকারী এই বরাহশাবকদের।
বিদ্যানন্দ শুরুতে এসবে পাত্তা দেয়নি। তাদের কাজ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষকে সাহায্য করা- সেটাই তারা করে গেছে একমনে, এক নিবিষ্টে। কিন্ত দিনের পর দিন ধর্মান্ধদের এসব ফতোয়া এসেছে, পাহাড় জমেছে। তখন বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তিনি ভেবেছেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তার থাকাটা যদি কিছু মানুষের বিরক্তির কারণ হয়, তাহলে তিনি সেখান থেকে সরেই যাবেন।
কারণ উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয় নিয়ে অনেকেরই চুলকানি আছে, তারা অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। এসবের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় দানের কার্যক্রম, কমে যায় অনুদানের গতি। বিদ্যানন্দ মানুষের জন্যে কাজ করার প্রতিষ্ঠান, অহেতুক বিতর্কের জন্ম দেয়ার জন্যে তিনি বিদ্যানন্দ বানাননি- এমনটাই হয়তো ভেবেছেন কিশোর কুমার দাস। তিনি চিন্তা করেছেন, বিদ্যানন্দের প্রধান হিসেবে তার না থাকায় অনুদানের গতি যদি ঠিক থাকে, কাজে যদি ব্যাঘাত না ঘটে, তবে তাই হোক!
আর সেকারণেই কিশোর কুমার দাস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিদ্যানন্দের প্রধানের পদ থেকে তিনি সরে যাবেন। প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি জানিয়েও দিয়েছেন সেটা। তবে বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না তিনি, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কিশোর কুমার দাস। তার কাছে কাজটাই আসল, পদ যাই হোক না কেন! করোনার প্রকোপ থামলেই এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ্যে আনার কথা ছিল বিদ্যানন্দ পরিবারের, কিন্ত মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের কারণে নিজেদের ফেসবুক পেজ থেকে ঘোষণাটা আজই দিয়ে দিলো বিদ্যানন্দ।
এই মানুষটার কথা একবার ভাবুন। ছোটবেলা কেটেছে প্রচণ্ড অভাবে, অবহেলায়। দু'বেলা পেট ভরে খাওয়াটা তার কাছে ছিল বিলাসিতার শামিল। ধনী-গরীবের বৈষম্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। পরিণত বয়সে সেই মানুষটা নিজের জীবনে সফল হয়েছেন, সেই সফলতার ভাগীদার করতে চেয়েছেন অভাবী-অসহায় মানুষকেও। গড়ে তুলেছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, দাঁড়িয়েছেন ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে, তাদের মুখে তুলে দিয়েছেন খাবার।
অথচ একদল ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ, তার বিরুদ্ধে সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়ে তাকে তার সন্তানসম প্রতিষ্ঠান থেকে দূর করতে চাইছে! কারণ তিনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারী নন, তার প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যে উর্দু বা আরবি শব্দ নেই! অথচ এই বিদ্যানন্দ নামটি একজন মুসলমান স্বেচ্ছাসেবীর দেয়া, বিদ্যানন্দ ত্রাণ বিতরণের সময় কখনও ধর্ম বিবেচনা করেনি, কখনও হিন্দু বলে কাউকে পাঁচ কেজির জায়গায় সাত কেজি চাল দেয়নি। অথচ আজ সেই বিদ্যানন্দকেই তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে বলতে হচ্ছে, আমাদের ৯০% ভলান্টিয়ার মুসলমান... এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি? মানুষের জন্যে কাজ করার এই কি প্রতিদান?
প্রিয় কিশোর কুমার দাস, এই লেখাটি আপনার চোখে পড়ার কথা নয়। আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে, বিদ্যানন্দের সেই ফেসবুক পোস্টের কমেন্টগুলো দয়া করে একবার পড়ুন। দেখুন, কত হাজার হাজার মানুষ এই ধর্মান্ধ ইতরদের বিরোধিতা করছে, আপনাকে সমর্থন জানাচ্ছে। তারা আপনাকে ভালোবাসে, আমরা আপনাকে ভালোবাসি কিশোরদা! এই ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করার অধিকার বা ক্ষমতা, কোনটাই আপনার নেই। আপনি বিদ্যানন্দের প্রধানের পদ থেকে সরে গেলে বিদ্যানন্দ হয়তো ঠিকঠাক চলবে, কিন্ত ধর্মান্ধতা জিতে যাবে, এরপরে তারা আসবে বিদ্যানন্দের নাম বদলানোর ফতোয়া নিয়ে। সেটা কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না, এই অমানুষগুলোকে জিততে দেয়া যাবে না...