কিরা লি: পর্নস্টার নন, মমতাময়ী এক শিল্পীর গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ড্যানি ড্যানিয়েলসের নাম শুনলে হয়তো নগ্ন এক প্রতিমূর্তি ভাসে আপনার চোখে। কিন্ত ছবি এঁকে এবং বিক্রি করে এই তরুণী যে অজস্র অসহায় মানুষকে সাহায্য করছেন, সেই গল্প কি জানেন আপনারা?
তিনি একজন প্রফেশনাল পর্নস্টার। লোকে তাকে ড্যানি ড্যানিয়েলস নামে চেনে। যদিও তার আসল নাম কিরা লি ওরস্যাগ। পর্নহাবে তার একেকটা ভিডিওতে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ, অন্যান্য ওয়েবসাইটের কথা বাদই দিলাম। বিশ্বজুড়ে তার লাখ লাখ ভক্ত, তবে প্রকাশ্যে খুব বেশি মানুষ সেটা স্বীকার করবে না। নীল ছবির জগতে তিনি মোটামুটি কিংবদন্তীতুল্য, 'পর্নোগ্রাফির অস্কার' খ্যাত এভিএন অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন পাঁঁচবার। একেকটা ফিল্মে অভিনয়ের জন্যে রেকর্ড পারিশ্রমিক নেন তিনি।
লেখাটা ড্যানি ড্যানিয়েলসকে নিয়ে নয়, এই ছদ্মনামের আড়ালে থাকা কিরা লি নামের মানুষটাকে নিয়ে। ড্যানি ড্যানিয়েলসের ২০/৩০/৪০ মিনিটের ভিডিও ক্লিপসে বুঁদ হয়ে থাকা আপনারা কি জানেন, পর্ন ইন্ডাস্ট্রির বাইরে এই ভদ্রমহিলা দারুণ একজন আঁকিয়েও? অ্যাডাল্ট ফিল্মে অভিনয়টা তার পেশা হলেও, নেশা কিন্ত ছবি আঁকা। অবসর সময়ে তিনি বসে পড়েন রঙ-তুলি নিয়ে, জলরঙ-তেলরঙ দিয়ে ছবি আঁকেন মনের মাধুরি মিশিয়ে। সেই ছবিতে মিশে থাকে আনন্দ, দুঃখ, হতাশা- সবকিছুই।
তার আঁকা ছবি নিয়ে এক্সিবিশান হয়, নিলামে হাজার হাজার ডলারে বিক্রি হয় সেসব ছবি। সেই ছবি বিক্রি করা একটা টাকাও নিজের হাতে তোলেন না কিরা লি, পুরোটাই চলে যায় দাতব্য সংস্থায়। কয়েকটা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার, ভাগাভাগি করে সেগুলোতে প্রতি বছরই বড় অংকের টাকা দান করেন কিরা। এই যে করোনার প্রকোপে বিশ্ব থমকে আছে, রোজগার হারিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছে নিম্নবিত্ত মানুষজন, এই দুঃসময়েও কিরা লি এগিয়ে এসেছেন, দান করছেন দু'হাত খুলে। নতুন ছবি আঁকছেন, অনলাইনে সেগুলো বিক্রি করছেন, সেই টাকা সরাসরি চলে যাচ্ছে দুর্গতদের সাহায্যার্থে।
জন্ম হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাবা এসেছিলেন চেক রিপাবলিক থেকে, মা আমেরিকান। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ দেখেছেন, ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে বড় হয়েছেন, আদর-ভালোবাসা খুব একটা জোটেনি কপালে। নিজের না পাওয়ার কষ্টগুলো কাগজে ছবি এঁকে প্রকাশ করতে চাইতেন, তখন থেকেই আঁকাআঁকির সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু। পরে তো সেটাই হয়ে গেল সবচেয়ে কাছের সঙ্গী।
ছবি আঁকা শিখবেন বলে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে ভর্তি হয়েছিলেন স্যান ডিয়েগোর আর্ট ইন্সটিটিউট অব ক্যালিফোর্নিয়াতে। কিন্ত গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ হয়নি তার। ড্রপআউট হয়ে চলে এলেন লস অ্যাঞ্জেলসে। ভীষণ ব্যস্ত শহর, টাকা না থাকলে এখানে কেউ কাউকে দুই পয়সার দাম দেয় না। সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া ড্যানিও টাকার পেছনে ছুটলেন। বাবাকে পাননি ছোটবেলা থেকেই, জীবনের অনেক সাধ-আহ্লাদ অপূর্ণ থেকে গেছে। হয়তো জেদ চেপে বসেছিল, সেসব পূরণ করেই ছাড়বেন।
লস অ্যাঞ্জেলস জায়গাটাই পর্ন ইন্ডাস্ট্রির জন্যে বিখ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অ্যাডাল্ট ফিল্ম নির্মিত হয় আমেরিকার এই অঙ্গরাজ্যে, পর্ণ ফিল্মের স্বর্গও বলা যায় এটাকে। সুন্দরী ছিলেন, মডেলিংয়ের জন্যে বিভিন্ন এজেন্সিতে ছবি জমা দিয়েছিলেন। স্কাউটদের চোখে পড়তে দেরী হলো না। প্রস্তাব এলো নীল ছবিতে অভিনয়ের। খুব বেশি ভাবার সময় ছিল না হাতে, হ্যাঁ বলে দিলেন। নতুন নাম দেয়া হলো তার- ড্যানি ড্যানিয়েলস। শুরু হলো নতুন এক জীবন, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন এখানেও আছে, তবে এখানকার কাজগুলো একটু আলাদা।
কিরা লি নামটা দিয়েছিলেন বাবা। তাকে বেশিদিন পাননি কাছে, কিন্ত পিতৃপ্রদত্ত এই নামটা তার ভীষণ প্রিয়। নীল ছবির স্ক্রলেই শুধু তিনি ড্যানি ড্যানিয়েলস, বাকী সব জায়গায় আসল নামটাই ব্যবহার করেন তিনি। নিজের কাজ নিয়ে কোন ধরণের অনুতাপ বা অনুশোচনা নেই তার। বরং নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে ভাবেন। গর্ব করেই বলেন, "আমি আত্মহত্যা করতে পারতাম, ড্রাগের নেশায় পড়ে শেষ হয়ে যেতে পারতাম। কই, সেরকম কিছু তো হয়নি! মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। অ্যাডাল্ট ফিল্মে কাজ করি বলে লজ্জা পেতে হবে কেন? যারা টাকা খরচ করে আমাদের দেখছে, তারা তো লজ্জা পায় না!"
জানি, এই লেখাটা পড়ে অনেকেই হাসবেন, বলবেন, ভূতের মুখে রাম নাম! তাতে কারো কিছু আসে যায় না। ড্যানি ড্যানিয়েলস নামটা শুনলে আপনাদের ঠোঁটের কোণে চিকন হাসির রেখা ভাসে, আপনারা মানসপটে দেখতে পান তার নগ্ন প্রতিমূর্তি। অথচ আমি কিরা লি ওরস্যাগ নামের এক মমতাময়ী তরুণীকে দেখি। জীবনের অনেকটা সময় যে ভালোবাসাহীন অবস্থায় কাটিয়েছে, ভালোবাসার অভাব কী জিনিস, সেটা যে বোঝে। তাই তো ভালোবাসা বিলিয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।
লকডাউনের এই দিনগুলোতে তিনি এঁকে যান নিরন্তর। যতো বেশি আঁকতে পারবেন, তত বেশি টাকা আসবে। সেই টাকার সামান্য ভাগও তিনি পাবেন না, সেটা জেনেই কিরা লি এই কষ্টটুকু করতে থাকেন। কারণ এই ছবিগুলো বিক্রির টাকা পৌঁছে যাবে না খেয়ে থাকা অনাহারী মানুষের কাছে, তার আঁকার শ্রমে কেউ হয়তো দু'দিনের অভুক্ত পেট নিয়ে বার্গারে একটা কামড় বসাবেন। অনুন্নত দেশগুলোর নির্যাতিত, অ্যাসিডে দগ্ধ বা প্রতিবন্ধী নারীদের কাছেও পৌঁছে যাবে এই ছবি বিক্রি করে পাওয়া টাকার একটা ভাগ- সেভাবেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন কিরা লি।
তিনি পর্নস্টার, অ্যাডাল্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ব্যস্ত নায়িকা, পরিচালকেরা বসে থাকেন তার শিডিউলের আশায়। ক্যামেরা বন্ধ হয় একসময়, শুটিং প্যাকআপ। কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরেন কিরা লি, ড্যানি ড্যানিয়েলস নামে যাকে খুঁজে ফেরে নেটিজেনরা। এক কাপ কফি বানিয়ে তিনি বারান্দায় বসেন, মায়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করেন হয়তো, তারপর হাতে তুলে নেন রঙ-তুলি। পেশা থেকে তিনি ঢুকে যান নেশার ভেতর। মানুষ-গাছ-পাতা, ধীরে ধীরে ছবিটা স্পষ্ট হতে থাকে, ছবি প্রাণ পায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, কিরা লি'র আঁকা ওই ছবিতে ফুটে উঠছে অসহায় কিছু মানুষের মুখ, কৃতজ্ঞ চেহারায় যারা তাকিয়ে আছেন, ধন্যবাদ দিতে চাইছেন। এই মহানুভবতার জন্যে কিরা লি তো ধন্যবাদ পেতেই পারেন, তাই না?