সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন এবং ডোপামিন হরমোন তিনটির কাজ হলো আমাদেরকে সুখী এবং সুস্থ্য রাখা। এই হরমোনগুলোর ইমব্যালেন্স হলেই আমরা দুঃখী হয়ে পড়ি, ডিপ্রেশনে চলে যাই। সেরোটোনিন, ডোপামিন আর্টিফিশিয়ালভাবে দেয়া হলেও অক্সিটোসিন কৃত্রিমভাবে তৈরী করা যায় না। তাহলে?
প্রতিবছর সারার স্কুলে একটি থিম সিলেক্ট করা হয়। তারপর সারাবছরব্যাপী যতরকম এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটি আছে সবকিছুতেই সেই থিম ফলো করা হয়। এই বছরের থিম ছিলো 'কাইন্ডনেস'। এই শব্দটি আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে পছন্দের শব্দ। আমি মনে করি শুধু এই একটি শব্দের জন্য আমি এখনো পর্যন্ত প্রায় শ'খানেক মানুষ রাগের চোটে গুলি করে মেরে ফেলিনি। জীবন যে জেলখানায় কাটলো না এজন্য এই শব্দের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অসীম।
তো কয়দিন আগে সারাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা কাইন্ডনেস কী, একটু বলতো শুনি? সারা তখন মাত্র স্কুল থেকে এসেছে, জুতা মোজা খুলে, টেবিলের উপর পা তুলে সে ঠান্ডা শশা খাচ্ছে। সেই ঠান্ডা শশা খেতে খেতে বিজ্ঞের মতন বললো, তুমি যখন কাউকে জাজ করবে না সেটাই কাইন্ডনেস।
আমি আশা করেছিলাম সারা বলবে- তুমি যখন মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করবে, মানুষকে সাহায্য করবে, বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়াবে সেটাই কাইন্ডনেস। কিন্তু এই মেয়ে এক বাক্যে আমাকে যা বললো, আমি তাতে থতমত খেয়ে গেলাম। সন্তানের বয়স ছয় ক্রস করলেই বোধহয় তারা নিয়মিত আমাদেরকে কোনো না কোনোভাবে চমকে দেয়।
মাদার তেরেসা বলেছিলেন, “When you stop to judge people, you start to love them”
মানুষের সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করা, মানুষকে ভালোবাসার মূলমন্ত্র হলো- তাকে তার ভুলত্রূটি নিয়েই গ্রহণ করা। যখন আমরা কোনো মানুষকে অপছন্দ করি, তাকে নিচু করতে ভালোবাসি, তখন তার ভুলত্রূটির বস্তা খুলে বসি। অথচ আমরা জানি না এই বস্তা আমাদেরকেই কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হয়। যার ভুলত্রূটির বস্তা আমাদের কাছে আছে, তাদেরকে কখনো সেই বস্তা বহন করতে হয় না। ইনফ্যাক্ট তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই বস্তার খবর জানেও না।
সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন এবং ডোপামিন বলে তিনটি হরমোন আছে আমাদের শরীরে। এই তিন হরমোন আপন ভাইবোন। এদের একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যায়। এই তিনটি হরমোনকে বলা হয় লাভ হরমোন।এই তিনটির যৌথ প্রযোজনা ছাড়া ভালোবাসা হয় না।এদের ছাড়া ভালোবাসার অস্তিত্ব তৈরিই হবে না। এই হরমোনগুলোর কাজ হলো আমাদেরকে সুখী এবং সুস্থ্য রাখা।
এই হরমোনগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় যখন আমরা কোনো খারাপ সংবাদ পাই। ফলে তখন আমাদের দুর্বল দুর্বল লাগে। এই হরমোনগুলো আমাদের মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ স্লো করে দেয়, যখন আমরা রেগে যাই। এজন্য আমাদের প্রেসার বেড়ে যায়, ব্রেন স্ট্রোকও হতে পারে অতিরিক্ত রাগ বা স্ট্রেস থেকে। এই হরমোন কমে গেলে এঞ্জাইটি এটাক হয়, ফলস্বরূপ আমাদের অত্যাধিক ঠান্ডা লাগে, তাই যখন আমরা ভয় পাই আমাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, লোম দাঁড়িয়ে যায়।
এই হরমোন সবচেয়ে বেশি কমে যায়, একেবারে নিম্ন লেভেলে চলে যায় খুন, ধর্ষণজাতীয় গহির্ত কাজ করার সময়। ঠিক একই লেভেলে এই হরমোন কমে যায় যখন কেউ আত্মহত্যা করে বা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই হরমোন প্যারামিটারে কমের দিকে থাকে যখন আমরা মিথ্যা বলি এবং ভণ্ডামি করি বা কাউকে ঠকাই।
এইগুলো খুব সাধারণ উদাহরণ। অসাধারণ উদাহরণ হলো, এই হরমোন সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় ইন্টারকোর্স, ব্রেস্ট ফিডিং এবং লেবার পেইন টাইমগুলোতে। আরো অনেক সময় এই হরমোনেরা আমাদের শরীরে নাচানাচি করে, তবে এই তিনটি মুহূর্ত মানবজীবনের অসাধারণ মুহূর্ত হিসেবে ধরা হয়। তার প্রমাণস্বরূপ থেকে যায় এই তিন হরমোনের উচ্চ মাত্রার প্যারামিটার।
সোজা বাংলায় আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন সুখের উৎস খুঁজে, সেরোটোনিন সুখের উপাদান তৈরী করে আর ডোপামিন সুখানুভুতি ছড়ায়।
যেকোনো মানসিক রোগের ঔষুধে সেরোটোনিন, ডোপামিন আর্টিফিশিয়ালভাবে দেয়া হয়। কিন্তু তবুও সব মানসিক রোগ ঔষুধ খেলেই কেন চলে যায় না? কারণ অক্সিটোসিন এখানে বাগড়া বাজায়। অক্সিটোসিন কৃত্রিমভাবে তৈরী করা যায় না। এখনো পর্যন্ত রিসার্চ ফিসার্চ করে মেডিকেল সাইন্টিস্টরা বলেছেন অক্সিটোসিন তৈরী হতে পারে- এক্ট অব কাইন্ডনেসে, সোশ্যাল বন্ডিং এবং প্রেম ভালোবাসায়।
কাইন্ডনেস দিয়েই মানুষ তার শরীরে অক্সিটোসিন বাড়িয়ে ফেলতে পারে? অক্সিটোসিন বাড়ালে কী হবে?
প্রথমেই যা হবে তা হলো আপনার ডিপ্রেশন কমে যাবে এবং আপনি যদি নিয়মিত এই চর্চা করেন, তবে ডিপ্রেশন পুরোপুরি চলে যাবে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে অল্প একটু হলেও যদি আপনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন, আপনার স্ট্রোকসহ, ব্লাড প্রেসার, সুগার, ডিপ্রেশন, এঞ্জাইটি, প্যানিক স্ট্রেস (নট এটাক) সম্ভাবনা কমে যাবে।
অদ্ভুত না? আমাদের জন্মই হয়েছে অন্যের প্রতি দয়াশীল হবার জন্য। আমাদের সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে আমরা কতখানি অন্যের পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম সেটার উপরে। প্রকৃতি এখনো মানুষকে কেনো আর্টিফিশিয়াল অক্সিটোসিন বানানোর ক্ষমতা দেয়নি? মেডিকেল সাইন্সে আমরা কত এগিয়ে আছি। তবুও প্রকৃতি কেনো কাইন্ডনেসের সম্পূরক আর কোনকিছুতে করতে দেয়নি?
সমস্যা হলো করোনার মধ্যে ঘরে বসে আর কতইবা কাইন্ডনেসগিরি করা যায়?
সেটার সমাধান লেখার প্রথমেই সারা বলে দিয়েছে...কাইন্ডনেস শুধু শীতের শাল বিতরণ বা মরণাপন্ন রোগীকে সাহায্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না। ঘরে বসে, ফেসবুকের স্ক্রিনে, কারো কোনো উপকার করতে না পারলেও অক্সিটোসিন বাড়ানো যায় শুধুমাত্র মানুষকে তার ভুলত্রূটিসহ গ্রহণ করার মাধ্যমে।
মানুষের অতীতের গল্প, অতীতের কর্মের যে ভলান্টারি হিসাবের বস্তা আপনার ঘরে বা ঘাড়ে আছে, সেই বস্তাটা ফেলে দেন। দেখবেন অক্সিটোসিন প্রবল উৎসাহে তার ভাই বোন সেরোটোনিন আর ডোপামিনকে নিয়ে আপনার মস্তিস্ক মাখামাখি করে ফেলবে।
সব ডিপ্রেশন ডিভোর্স বা সেপারেশন থেকে হয় না।
সব ডিপ্রেশন বাবা মা বা কাছের মানুষের মৃত্যুতে হয় না।
সব ডিপ্রেশন পরীক্ষার ফেল করার জন্য হয় না।
সব ডিপ্রেশন অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য হয় না।
আমেরিকার, ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো ২০১৭ সালে একটি রিসার্চ পেপার বের করেছিল। সেখানে বলা হয়েছে আমেরিকাতে ৬৫% ভাগ ডিপ্রেশন হয় শরীরের অক্সিটোসিন ইমব্যালেন্স। মানুষের প্রতি মানুষের রাগ, ক্রোধ, হিংসা, জাজমেন্টাল চিন্তাই মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ্য করে দিচ্ছে।
আজব! ৬৫% মানুষের ছোট বড় মাঝারি মানসিক রোগ ভালো হয়ে যেতে পারে শুধুমাত্র অন্য মানুষকে আমরা বিচার করা বন্ধ করে ফেলতে পারলে? ভালো মানুষ হবার জন্য খুনি, ধর্ষক, ভন্ড, মিথ্যাবাদী না হওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি অন্য মানুষকে তার ভুলত্রূটি দিয়ে বিচার না করাটাও সমপরিমান জরুরি।
লেখাটি উপদেশ উপদেশ টাইপ হয়ে গেলো, আমি আসলে বোধহয় বলতে চেয়েছিলাম আমার জীবনে আমি এতো জাজ্ড হয়েছি, একটা দুইটা সিঙ্গেল ঘটনা দিয়ে, কাছের মানুষরা এই পুরো আমাকে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় এতবার দাঁড় করিয়েছে, যে আমি ক্লান্ত। আমি যেহেতু ভাল্লুক বা মোটা চামড়ার পশু গোত্রের কেউ না, তাই আমি ধুম করে বলে ফেলতে পারি না- হু কেয়ারস?
বিকজ আই কেয়ারড। গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এতো সহজ না। এখন আমি মানুষের চোখ দেখলেই বুঝতে পারি সে আমাকে কতখানি সহজভাবে নিয়েছে, আমাকে আমার ভুলত্রূটিসহই গ্রহণ করেছে।
অতএব এই লেখাটি যদি উপদেশের মতন শোনায়, সেজন্য দুঃখিত। আমি আসলে অনুরোধ করতে চেয়েছি আর যাই করেন মানুষকে তার পুরোটা না জেনে জাজ করবেন না। এই অনুরোধ যারা করতে পারে না, তাদের হয়ে আমি করে ফেললাম। প্লাস জাজ না করলে আপনার মস্তিস্ক কতখানি সুস্থ থাকবে তার একটি সহজ ব্যাখ্যাও দিয়ে দিলাম।
সবার শরীরে অক্সিটোসিন তার ভাই বোন নিয়ে আনন্দে বিচরণ করুন। আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কে এদের মাত্রা ভয়াবহ বেড়ে যাক, এই কামনা করছি...
লেখক পরিচিতি- সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট
ফিচার্ড ছবি- কন্যা সারার সাথে লেখিকা
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন