চার বছরের ছেলে সিফাতকে অপহরণের পর মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে অপহরণকারীরা। একবেলা রান্না করার মতো চাল নেই যার ঘরে, সে কীভাবে যোগাড় করবে ৫০ হাজার টাকা?

ফিরোজ হাওলাদার। পেশায় রঙ মিস্ত্রি। চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে হাতিরঝিল থানাধীন মীরবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে। বড় ছেলের মধ্যে ছোট সিফাতের বয়স ৪ বছর।

সীমিত আয়ের সংসারে ভাড়া বাসায় থেকে স্ত্রী-সন্তানের মুখে দুবেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হয় ফিরোজ হাওলাদারকে। লক ডাউনের কারনে কাজ না থাকায় আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে সংসার চলছিল তার। লক ডাউনের কারণে ঘরে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছিল ছোট ছেলে সিফাত। ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হবে না জেনে মন আরো বেশী খারাপ।

২০ মে’ ২০২০, বুধবার। বাসার সামনেই খেলছিল সিফাত। পুলিশের দেওয়া আটায় রুটি বানাচ্ছিল তার মা। ক্ষুধার্ত সিফাতের জন্য। কাজ না থাকায় বিছানায় শুয়ে ফিরোজ হাওলাদার। সকাল এগারোটার দিকে স্ত্রীর চিৎকারে রুমের বাইরে আসে ফিরোজ হাওলাদার। তার স্ত্রী রুটি বানাতে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল রাখতে পারেননি সিফাতের। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সিফাতকে।

ফিরোজ ও তার স্ত্রীর আর্ত চিৎকারে জড়ো হলো আশেপাশের লোকজন। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো বাসার চারপাশ। বাসা পেরিয়ে আশেপাশের রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, পরিচিতদের বাড়িঘর। খবর শুনে ছুটে এলো ফিরোজের পরিচিত কয়েকজন রঙ মিস্ত্রি, বন্ধু-বান্ধব ও আত্নীয়-স্বজন। আলাদা আলাদাভাবে খোঁজা হলো পুরো এলাকা। মগবাজার, পেয়ারাবাগ, আমবাগান, পাগলা মাজার, মধুবাগ, নয়াটোলা, হাতিরঝিল, দিলুরোড, ইস্কাটন, রমনা, সাত রাস্তা, মহাখালী, রেলওয়ে স্টেশন, কাওরানবাজার। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে চলে গেল আশেপাশের থানাগুলোতে। সিফাতের কোনো সন্ধান নেই।

দুপুর সোয়া একটার দিকেঅজ্ঞাত একটি মোবাইল নম্বর থেকে সিফাতের বাবার মোবাইলে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, ‘সিফাতকে অপহরন করা হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে সে তার ছেলেকে ফিরে পেতে পারে। পুলিশকে জানালে বা কোনরকম চালাকি করলে ছেলের লাশের খোঁজও পাবে না’। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ফিরোজ হাওলাদারের। একবেলা রান্না করার মতো চাল নেই যার ঘরে, সে কিভাবে যোগাড় করবে ৫০ হাজার টাকা। পুরো বিষয়টি মোবাইল ফোনে হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশীদকে জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিফাতের বাবা।

সিফাতকে মুক্তিপণের জন্য অপহণ করা হয়েছে বিষয়টি হাতিরঝিল থানা পুলিশকে জানানো হয়েছে জানতে পারলে অপহরনকারীরা সিফাতকে মেরে ফেলতে পারে - এই ভয়ে হাতিরঝিল থানা পুলিশের সাথে ফিরোজ হাওলাদারকে যোগাযোগ করতে দিতে চাচ্ছিলো না অপহৃত সিফাতের মা। পুলিশ তার সাথে বার বার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করার এক পর্যায়ে সিফাতের মা মোবাইল নম্বরটি বন্ধ করে ফেলে।

এ ঘটনা জেনে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার সিফাতের বাসা খুঁজে তার মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে অপহৃত সিফাত উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বাসায় না ফেরার নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদেরকে। বিকেল ০৩.২৫ ঘটিকায় ফিরোজ হাওলাদারের বাসা খুঁজে পায় হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

সিফাত অপহরণের বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে অপহরণকারী তা ঘূনাক্ষরেও টের পাবে না বুঝিয়ে আশ্বস্ত করা হয় অপহৃত সিফাতের বাবা-মাকে। দুই বছর আগে তোলা সিফাতের একটি সাদাকালো ছবি ছিল বাবা-মা’র কাছে।

পুলিশের পরামর্শে অপহরণকারীদের সাথে মোবাইলে মুক্তিপণের বিষয়ে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে থাকে ফিরোজ হাওলাদার। সামান্য হেরফের হলেই প্রতি মুহূর্তেই সিফাতের ছিন্নভিন্ন লাশ বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকি।

বাবার কোলে সিফাত

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক এর তত্ত্বাবধানে এসআই শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে হাতিরঝিল থানার একটি টীম রাত ১১. ৪০ ঘটিকায় মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করে সিফাতকে। অপহরণকারীদের তাড়া করে ডেমরা, মিরপুর, সাভার হয়ে রাত ১০.৫০ ঘটিকায় পাটুরিয়া ঘাটে পৌছে হাতিরঝিল থানা পুলিশের টীম।

প্রচন্ড বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষ্যে সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করে গ্রামে ফিরতে উদগ্রীব মানুষে জনাকীর্ন পাটুরিয়া ঘাট। নৌযান চলাচল বন্ধ। কালক্ষেপণ না করে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়াকে উপেক্ষা করে সিফাতকে খুঁজতে শুরু করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। টীমটি দুভাগে ভাগ হয়ে খুঁজতে থাকে সিফাতকে। সম্বল সিফাতের দুই বছর বয়সের একটি সাদাকালো ছবি। সিফাতের বাবাকে একটু দূরে গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যদি অপহরণকারীরা তাকে দেখে সিফাতকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়। সিফাতের বাবাও চাচ্ছিলেন না গাড়ি থেকে নামতে। যদি অপহরণকারীরা তাকে পুলিশের সাথে দেখে সিফাতের কোন ক্ষতি করে!

উদ্ধারের পর সিফাত

রাত ১১.৪০ ঘটিকায় পুলিশ একটি টং ঘরের দেয়াল ঘেষে ঘুমন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে সিফাতকে। গাড়ি থেকে ডেকে আনা হয় তার বাবাকে। বাবাকে দেখে কোলে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে সিফাত। সিফাত জানায়, ‘সে যখন বাসার বাইরে খেলছিল, তখন ‘মিলন মামা’ চকোলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে দোকানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে নিয়ে যায়। মিলন কয়েক মাস যাবত সিফাতের বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করছিল। বাসায় প্রায়ই আসতো। মিলনকে মামা ডাকতো সিফাত। মিলনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

(ডিসি তেজগাঁও ডিএমপি পেজ থেকে সংগৃহীত)


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা