এই পর্যন্ত ৮৭ জন করোনায় আক্রান্ত রোগীর শেষকৃত্য হয়েছে আপনার হাতে। এরপর নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সস্ত্রীক। সুস্থ হয়ে উঠার পর এতটুকুও বিশ্রাম নেই, এবার ডোনেট করেছেন প্লাজমা। কে বলেছে আমাদের সুপারহিরো নেই?
করোনার ধকল থেকে নিজে সেরে উঠেছেন খুব বেশিদিন হয়নি। শরীর দুর্বল এখনও। কিন্ত তাতে কি? ভালো কাজের নেশা যাকে পেয়ে বসেছে, তিনি কি আর ঘরে বসে থাকতে পারেন? তাই তো মধ্যরাতে করোনায় আক্রান্ত এক রোগীকে প্লাজমা দিতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ছুটে গেলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, প্রায় শ'খানেক করোনায় আক্রান্ত রোগীর শেষকৃত্য হয়েছে যার হাতে!
করোনা রোগীদের জন্য প্লাজমা থেরাপি বেশ কাজে দিচ্ছে। বিশেষ করে মুমূর্ষু রোগীদের ক্ষেত্রে শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে এটি। করোনা থেকে সেরে ওঠা কারো প্লাজমা রোগীর শরীরে দেয়া হলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটা এন্টিবডি তৈরী হয় রোগীর শরীরে। তবে এক্ষেত্রে রোগী এবং রক্তদাতা- দুজনের রক্তের গ্রুপই একই হতে হবে। এজন্য করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদের প্লাজমা দানে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মাত্র ২০০ মিলিলিটার প্লাজমা দানে বেঁচে যেতে পারে কারো প্রাণ।
কাউন্সিলর খোরশেদ সেই মুমূর্ষু প্রাণ বাঁচানোর কাজটাই করেছেন। এপর্যন্ত প্রায় ত্রিশটি প্লাজমা দান করার কথা জানিয়ে তিনি বলছিলেন- মানুষের প্রয়োজনে আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি। এটি আমাদের টিমের ৩০ তম প্লাজমা ডোনেশন। আজ ‘বি’ পজিটিভ প্লাজমা প্রয়োজন ছিল। প্লাজমা ডোনেশন টিম প্লাজমা দিতে গেলে পরপর দুজন ডোনারের অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় রিজেক্ট হয়। পরে মানবিক কারণে আল্লাহর রহমতে আমি নিজেই হাসপাতালে গিয়ে ২০০ এমএল প্লাজমা ডোনেশন করি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমি করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর দ্রুত আমার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
কাউন্সিলর খোরশেদ করোনা থেকে সেরে উঠেছেন অল্প কয়েকদিন হলো। সস্ত্রীক করীনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি, একটা অবস্থায় তো এমন হয়েছিল, তার স্ত্রীকে ভর্তির জন্য কোন হাসপাতালে আইসিইউ খালি পাচ্ছিলেন না। পরে নারায়ণগঞ্জের এক সাংসদের সুপারিশে দুজনকেই ভর্তি করা হয় স্কয়ার হাসপাতালে। সেখান থেকেও চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ না করেই বাসায় ফিরেছিলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনে, কারণ বিশাল অংকের বিলের বোঝা টানা সম্ভব ছিল না খোরশেদ কাউন্সিলর্র পক্ষে। আপাদমস্তক সৎ রাজনীতিবিদ তিনি, নইলে হয়তো স্কয়ারের মতো ফাইভস্টার হাসপাতালে মাসের পর মাস কাটানোটাও তার জন্য কোন ব্যাপার ছিল না।
এই খোরশেদ কাউন্সিলরই করোনার দুর্যোগের সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মানুষের বিপদে। এই ভদ্রলোক তার দলবল নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের লাশ দাফন করছেন গত ৮ই এপ্রিল থেকে, লাশের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করেননি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। তার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন তার স্ত্রীও। কিন্ত এসবকিছুই খোরশেদ কমিশনারকে, করোনা থেকে সেরে উঠেই তিনি আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাজে। এতদিন মৃতের সৎকার করেছেন, এখন জীবিত মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন, মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ছুটে যাচ্ছেন প্লাজমা দিতে।
এপর্যন্ত দলবল নিয়ে ৮৭টি মৃতদেহকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষ বিদায় জানিয়েছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। সব খরচ বহন করেছেন তিনি নিজে। শুধু দাফন-সৎকার নয়, যতোভাবে সম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পরে দোকান থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর হেক্সিসল উধাও হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেও কিনতে গিয়ে পাননি। পরে গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী কাঁচামাল কিনে নিজেই লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ষাট হাজার বোতল হেক্সিসল বানিয়ে ফেলেছেন, সেগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন শহরের লোকজনের মধ্যে।
করোনাভাইরাস আমাদের ভেতরের পশুটাকে বের করে এনেছে, মনুষ্যত্বের মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলেছে। চারপাশে অজস্র হৃদয়বিদারক ঘটনার নজির দেখছি আমরা। করোনা সন্দেহে মা'কে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে ছেলে, কিংবা আক্রান্ত সন্তানকে বাঁশঝাড়ে রেখে গিয়েছে বাবা-মা। কোথাও হয়তো সন্তানদের কাছে চিৎকার করে খাবার আর পানি চেয়েও পাননি বাবা, তাকে আটকে রাখা হয়েছে রুমে, সেখানেই মারা গেছেন তিনি। এই দুঃসময়ে কাউন্সিলর খোরশেদের মতো মানুষগুলোকে উপন্যাস থেকে উঠে আসা দেবদূত বলে মনে হয়, আমাদের সমাজে যারা ভীষণ ব্যতিক্রম, একদম অন্যরকম...