
এক যুবক মরা একটা লাশের চেরা বুক থেকে কলিজা খাচ্ছে। সে মরা মানুষের কলিজা মাংস খায়।
১৯৮৩/৮৪ সালের দিকের ঘটনা। প্রতি বছরের মতো ঈদ ও শবে বরাত সন্ধ্যায় দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করতে যেতাম বাবার সাথে আজিমপুর পুরোনো কবরস্থানে। সেবার গোরস্তান থেকে বের হবার পর আব্বা একজনের সাথে কথা বলেন বেশ সময় ধরে। আর হাতে গুঁজে দেন নতুন চকচকে দশ টাকার নোট। আমার কৌতুহলী মনের ভাব বুঝে রিক্সায় বসে প্রশ্ন করলেন, ওকে তুমি চেনো? উত্তরে বললাম, না। আব্বা বললেন, ও হচ্ছে খইল্লা, সবাই খইল্লা পাগলা বলেই ডাকে। ভাল নাম খলিলুল্লাহ। এক সময় ও মানুষের কলিজা, মাংস খেত। তবে এখন সে সুস্থ।
ভাবলাম আমার ঢাকাইয়া আব্বাজান চাপা ছাড়বার লাগতাছে নাকি! যাক সে সময় দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা মানুষের মনে চাপাপড়া এক ঘটনা। ৩রা এপ্রিল ১৯৭৫। দৈনিক বাংলা একটা বক্স নিউজ করে ছবি ছাপে সেখানে দেখা যায় এক যুবক মরা একটা লাশের চেরা বুক থেকে কলিজা খাচ্ছে। সে মরা মানুষের কলিজা মাংস খায়। শুরু হলো শহরজুড়ে কৌতুহল, হুলস্থূল আর গুজবের ডালপালা! কর্তৃপক্ষের টনক নড়তে সময় লাগল পাক্কা দুইদিন। বিচিত্রা তৈরী করলো কভার স্টোরি। খলিলুল্লাহ নরমাংসের নেশায় ঢাকা মেডিকেলে আসতেই কর্মচারীরা তাকে ধরে ফেললেন। তারপর সোজা তত্ত্বাবধায়ক কর্ণেল রহমানের রুমে হাজির করা হল। কর্ণেল সাহেব ডেকে পাঠালেন অধ্যক্ষ ডাঃ এম এ জলিল সহ আরো কয়েকজন মানসিক বিশেষজ্ঞকে। অভয় দেয়া হল সব খুলে বলতে। আর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কাহিনী তার জবানবন্দিতে।
রবি ডোম আর খলিলুল্লাহ ছিল ছোটবেলার বন্ধু। তখন তারা থাকত লালবাগ এলাকায়। সেখান থেকে হেঁটেই তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আসত। রবি ডোমের বাবা ছিল ঢাকা মেডিকেলের প্রথম ডোম। সে-ই খলিলুল্লাহ ও রবি ডোমকে প্রথম মরা মানুষের মাংস খেতে দিত। পরে রবি নরমাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেও খলিলুল্লাহ তা ছাড়তে পারেনি। পাঁচ দিন পর পর তার নরমাংস চাই। শুধু ঢাকা মেডিকেল নয়, মিডফোর্ড হাসপাতালের গোপাল ডোম ও সোনা ডোম তাকে খেতে দিত মরা মানুষের মাংস।

এছাড়াও লাশের কাফনের কাপড় চুরি করা ছিল তার নেশা। ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে কাপড় এনে বিক্রি করত পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার পুরান কাপড়ের দোকানে। তবে কাপড় বিক্রির টাকায় সে স্বাভাবিক খাবারই কিনে খেত। একবার তো সে তার খালা মমিনাকে মানুষের মাংস খাসির মাংস বলে রান্না করেও খাইয়েছে। এ সব শুনে সবাই তো হতবাক! তাৎক্ষনিক পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে আনা হল কাঁচা মুরগীর মাংস। বলা হল খেতে। দ্বিধাহীন ভংগীতে সবার সামনেই চিবিয়ে চিবিয়ে সাবাড় করল কাঁচা মুরগীটা।
এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, না একে তো আর জনসমক্ষে রাখা যাবে না; পরে না সে জ্যান্ত মানুষের ওপর পড়ে! ডাকা হল পুলিশ। লাগানো হলো হাতকড়া, নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। পুলিশি জেরার মুখে খলিলুল্লাহ দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষনা করলো, সে মানুষের মাংস খায় এবং ভবিষ্যতেও খাবে! সব শুনে পুলিশ বেশ ঘাবড়ে গেল। চালান করা হল ঢাকার আদালতে। নির্দেষ দেয়া হল পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসারর জন্য পাঠানো হউক। সত্তর দশকে এক সময় যার নাম শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠত আর মায়েরা শিশুকে ঘুম পাড়াতে বর্গী নয় খইল্লা'র কথা বলে! সময়ের স্রোতে আর কেউ খোঁজ রাখেনি এই আলোচিত মানুষখেকোর।
১৯৯৭ সাল। শবে বরাত সন্ধ্যারাত আজিমপুর কবরস্থানের গেটের একটু দূরে। আমি চিনতে না পারলেও আব্বা ঠিকই চিনলেন সেই খইল্লা পাগলাকে। এত বছরে অনেক পরিবর্তন। চুপচাপ, মৃদুভাষী ভাবুক একজন মানুষ। এখন তাকে আমার চিনে রাখার পালা। সভ্য সমাজের ভদ্রলোকেরা তাকে ঘৃণায় দূরে ঠেলে দিলেও কবরস্থানের ভাগ্যবিড়ম্বিত কিছু ভিক্ষুকেরা তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষুকের সারিতে বসে খলিলুল্লাহ ভাবত তার বিগত দিনের কথা। সেটা কি আসলেই সত্য!
অদ্ভুতদৃষ্টিতে মানুষের তাকিয়ে থাকা তাকে ভিন্ন প্রকৃতির কোন লোক মনে করে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো কমলার দিকে। কেউ কথা বলতে চায় না, সবাই দূরে চলে গেলেও এই কমলা আক্তার তার খোঁজ-খবর নিত, মাঝে খাবার দিত, অসুখ হলে ঔষুধ কিনে দিত দোকান থেকে। ভিক্ষুক সারিতে বসে মনের ভাব আদানপ্রদান আর সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করতে গিয়েই পাশের ভিক্ষারিনীকে ভাল লাগে তার। জীবনের শেষ অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরে তাকে। নূরজাহান বেগম। দুজনকে এক করে সংসার বাঁধার ব্যবস্থা করে অন্য ভিক্ষুকরা। কামরাঙ্গীর চরে বস্তিঘরে শুরু করে সংসার। দুজনের ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে কষ্টে চলতে থাকে জীবন আর তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। অনৈতিক কোন কাজে লিপ্ত হয়নি তারা। যে খলিলুল্লাহ মর্গ আর কবরস্থানে মরা মানুষের মাংস খুঁজে বেড়াত, সেই মানুষটি প্রেমের টানে সংসারের বিনি সুতোয় আটকা পড়ে যায়।

আজিমপুরের সহযাত্রীরা একবাক্য স্বীকার করে বিয়ের পর সে হয়ে গিয়েছিল অন্য এক মানুষ। খারাপ আচরণ তো দূর, প্রয়োজনের বেশী কথা বলত না। ভিক্ষাবৃত্তি শেষে কামরাঙ্গীরচরের ভাড়া বাসায় যাবার পথে রাস্তায় অনেকে তাকে কইলজা খেকো বলে তিরস্কার করলেও মাথা নিচু করেই সে চলে যেত।
জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে আজিমপুর করবস্হানের আশেপাশে। লম্বা কিছুটা কুঁজো মানুষটা সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকত। গেট পেরিয়ে কবরস্থানে তাকে কখনো ঢুকতে দেয়া হয়নি। এমনকি সে কখনো আবদারও করে নি। রমজান ও রাজ্জাক এখন ছোটখাটো কাজ করে। বাবার জন্য তাদের গর্ব হয়। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন আবার শাসনও।
রমজানের একদিন প্রচন্ড জ্বর। ঔষুধেও কাজ হচ্ছিল না। ছেলেকে ধরে সারা রাত জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করেন তার বাবা। তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে তাদের বাবা মানুষের মাংস খেত?
২০০৫ সাল। হাত পায়ে পানি এসে দুর্বিষহভাবে মারা যায় খলিলুল্লাহ। টাকার অভাবে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও সাহায্য পায়নি পরিবার। নুরজাহান বেগম এখন বৃদ্ধ ও অসুস্থ। কষ্ট স্বীকার করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর পাশে ছিলেন। নিজেকে কোনোদিন খলিলুল্লাহর স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে পারেন নাই। সবাই ধিক্কার দিলেও সে যে কত ভালো মানুষ ছিল স্ত্রী হিসেবে তার চেয়ে ভাল আর কে জানত!