খুলনার মেয়ে কাজী আসমা আজমেরী। আপনি কি জানেন, এই তরুণী কী এক অসম্ভব সুন্দর ঘটনা ঘটিয়েছেন?

খুলনার কন্যা কাজী আসমা আজমেরী। আপনি কি জানেন, এই তরুণী কি এক অসম্ভব সুন্দর ঘটনা ঘটিয়েছেন? তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের চিরায়ত সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে তিনি বিশ্বের একশোটির বেশি দেশে ভ্রমণ করেছেন, নিজে নিজে। সলো ট্যুর দেয়া, তাও আবার একশোটি দেশে, এটা অনেক দুঃসাহসিক, শেকল ভাঙ্গার গল্প। সম্প্রতি তার ভ্রমণের গল্প উঠে আসে দেশের প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায়। তিনি বলেন, "১০০তম দেশভ্রমণ আমার স্বপ্ন ছিল। আজ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি খুব আনন্দিত। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশ ঘুরেছে অনেকেই তার মধ্যে কেউ ফ্ল্যাগ বয় ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি পেয়েছেন। আমি কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ১০০টি দেশ ভ্রমণ করলাম। আমার শততম দেশ ভ্রমণ তুর্কিমিনিস্তানের স্ট্যাম্প দিয়ে পূরণ করলাম। এটা আমার জন্য গৌরবের বিষয়। ২৯ অক্টোবর স্মরণীয় একটা দিন। এই দিনটির জন্য দীর্ঘ দশ বছর ধরে লালন করেছি। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ আমার জন্য প্রায়ই অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমিও কম নাছোড়বান্দা নই, অসম্ভবকে সম্ভব করে আমার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি। 

হ্যাঁ, দীর্ঘ দশ বছর সময় নিয়ে তিনি একে একে একশটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তুর্কিমিনিস্থানের মাটিতে পা রাখার মাধ্যমে শততম দেশ ভ্রমণের যাত্রা পূর্ণ করেন তিনি। শুরুটা ২০০৮/০৯ সালের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তখন। এক বন্ধুর মা তাকে বলেন, "তুমি একজন দুর্বল ও যোগ্যতাহীন মেয়ে। আমার ছেলে ২০ দেশ ঘুরেছে। আর তুমি মাত্র দুটো দেশ ঘুরেছ। এতেই তোমার অহঙ্কার।" অহংকার দেখানোর জন্যে কেউ ১০০ দেশ ভ্রমণ করার দুঃসাহস দেখায় না, বিশেষত বাঙ্গালি তরুণীদের মধ্যে এই ধরণের আগ্রহ দেখানোটাও সমাজের চোখে সহজ ব্যাপার নয়।

আজমেরীর মনে কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন, তিনি বিশ্বভ্রমণটাকে সেদিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। এটা তার অহংকার না, নারীকে দুর্বল, যোগ্যতাহীন ভাবার যে মাইন্ডসেট সেটাকে ভুল প্রমাণেরই যেন প্রতিজ্ঞা। বলেছিলেন অন্তত ৫০টা দেশ ঘুরবেন। এশিয়ার দেশগুলো দিয়ে শুরু, তারপর ঠিকই তিনি ৫০ টা দেশ ঘুরেছিলেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। অবশেষে ২০১৮ সালের শেষদিকে এসে তার দেশ ভ্রমণের সেঞ্চুরি হয়! 

বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে একশোর বেশি দেশে ঘুরেছেন আসমা আজমেরী

কাজী আসমা আজমেরী যে দেশেই যান, সে দেশের জাদুঘরে গিয়ে দেশটার সভ্যতা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নেয়াও তার অন্যতম শখ। এই বিশ্বভ্রমণের কত শত গল্প তার ঝুড়িতে। সলো ট্যুর দিয়েছেন বলে, কখনো কখনো প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু, সাহসের সাথে উতরেছেন সব প্রতিবন্ধকতা। যেমন- একবার ভিয়েতনামে গিয়ে ফিরতি টিকেট না থাকায় তাকে জেলে থাকতে হয় ২৩ ঘন্টা। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন ব্রাজিলে। সেখানে মানিব্যাগ, কার্ড এসব চুরি হওয়ায় কয়েকদিন টাকার অভাবে খাবারের কষ্টও পেতে হয়েছে। কিন্তু, এসব কিছুই তার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে আজীবনের জন্য।

বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সব দেশে ভিসা পাওয়া, একসেস পাওয়া কিছুটা কঠিনই বটে। কিন্তু, কাজী আসমা আজমেরী বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই ঘুরে দেখিয়েছেন একশটি দেশ। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য- "আমি ২০১২ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসে কাজ করেছি কয়েক বছর। চেষ্টা করলে হয়তো ইউরোপীয় পাসপোর্ট পেতাম। কিন্তু কখনো চেষ্টা করিনি, দেশের পাসপোর্টেই নিজের পরিচয় দিতে ভালো লাগে।" যদিও বাংলাদেশি পাসপোর্ট ক্যারি করার কারণে অনেক সময় তাকে অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। একজন নারী, যিনি বাংলাদেশি তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছেন এটা মানতে যেন অনেকের কষ্ট। তবে সমর্থনও পেয়েছেন অকুণ্ঠ। তাই পৃথিবীবিখ্যাত মিডিয়াগুলো তাকে ফিচার করেছে, তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

কিছুদিন আগে তিনি এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদের আয়োজনে তিনি বক্তব্য দেন। শুনান নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এই যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। তিনি বলেন, "আমি আমার অলঙ্কার বিক্রি করে ভ্রমণের যাত্রা শুরু করি। কারণ অলঙ্কার পরায় আমার কোনো লাভ হবে না। বাঙালি মেয়েরা শাড়ি কেনে, আমি কিনেছি টিকেট। আমি চাই আমার ভ্রমণ হোক দুঃসাহসিক। আর আমার ভ্রমণ থেকে আমি শিখতে পেরেছি যে আমি যথেষ্ট শক্তিশালী। মেয়েরা দুর্বল নামে যে ধারণা প্রচলিত তা ভুল।" 

ভ্রমণ হচ্ছে সবচাইতে সুন্দরতম বিনিয়োগগুলোর একটি যা আপনাকে কখনোই হতাশ করবে না। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে আপনি জানবেন, বুঝবেন আবিষ্কার করবেন পৃথিবীর অনিন্দ্য সৌন্দর্য। কাজী আসমা আজমেরী সেই বিনিয়োগটা করেছেন। প্রমাণ করেছেন, নারীদের সীমানা ঘরের চারদেয়াল না, গোটা পৃথিবী! অভিনন্দন কাজী আসমা আজমেরীকে, বাংলাদেশের পতাকা, পাসপোর্টকে এশিয়া মহাদেশ থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য সব মহাদেশে- সর্বত্র আমাদের গর্বিত করবার জন্যে!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা