নরেন্দ্র মোদী সহ তার অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, তার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কানহাইয়া এমন সাহসী বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে, এক রাতের মধ্যে সারা ভারতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল...

Mohasin Hossain: ভারতের নির্বাচন নিয়ে কোনদিনই আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এবার একটা কারনে ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে অনেকটা আগ্রহ জন্মেছে। আর এর কারণ হলো কানহাইয়া কুমার, যে বিহারের বেগুসারাই থেকে সিপিআই'র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছে। কানহাইয়া কুমার ভারতীয় যুবাদের মধ্যে এতই আলোচিত যে এবার লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বানারাস, বা রাহুল গান্ধীর আমেথি বা ওয়ানাডের চেয়ে বেগুসারাই ভারতীয় মিডিয়ায় বেশি আলোচিত ছিল। 

কানহাইয়া কুমার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আসে গত বছর খানেক আগে। ইউটিউবে ভিডিও স্ট্রিমিং করতে করতে হঠাৎ একটি ভিডিও সামনে আসে, যেখানে কানহাইয়া কুমার দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রিডম স্কয়ারে দাঁড়িয়ে এমন এক ভাষন দেয় যেটা যে কোন সরকারের পক্ষে হজম করা অসম্ভব। আমাদের দেশে এমন বক্তৃতা কেউ দিলে পরের দিন তার নাম গুমের লিস্টে ঊঠে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০১%৷

কানহাইয়া কুমারের মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে উত্থান মূলত ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার পর। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশ্মীরি নাগরিক আফজাল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদে কিছু মানুষ একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এবং সেখানে নাকি ভারত বিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এর জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি পিএইচডি'র ছাত্র কানহাইয়া কুমার সহ উমর খালিদ, অনির্বান ভট্টাচার্য সহ অনেকের নামে রাজদ্রোহ বা দেশদ্রোহ মামলা হয়। 

এই মামলায় ২২ দিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে (বাংলাদেশে কারো বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে তার কী অবস্থা হত একবার চিন্তা করেন) বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রিডম স্কয়ারে দাঁড়িয়ে কানহাইয়া কুমার ৫২ মিনিটের একটি স্পিচ দিয়েছিল, যেটাকে অনেকে ছাত্র রাজনীতির হিস্টোরিকাল স্পিচ হিসেবে গন্য করে৷ ওই স্পিচে নরেন্দ্র মোদী সহ তার অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, তার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন সাহসী বক্তৃতা দিয়েছিল যে এক রাতের মধ্যে সারা ভারতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল (এই স্পিচ আমাদের দেশে কেউ দিলে পরের দিন তার নামে শ খানেক মামলা, শারীরিক আক্রমণ এমনকি বুড়িগঙায় সাতার কাটতেও দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে)। 

কানহাইয়া কুমার এখন ভারতের অনেক যুবার আইডল। তার ওরেটিং স্কিল এতই ভাল যে দূর-দুরান্ত থেকে শুধু তার বক্তৃতা শুনার জন্য মানুষ বিভিন্ন সভায় আসত। তার রাজনৈতিক জ্ঞান, চিন্তাধারা, ভিশন এতটাই স্ট্রং যে সহজেই ভারতের মানুষের মনোযোগ আকর্ষন করতে সক্ষম। যে কোন রাজনৈতিক নেতা তার সাথে ডিবেটে বসলে যে ন্যাংটো হয়ে যাবে সেটা সুনিশ্চিত। সে আরেকটা কারণে বিখ্যাত। সেটা হলো- তার আজাদী স্লোগান।। দেশের নানা সম্যসা থেকে আজাদী বা মুক্তি পাওয়ার জন্য এই স্লোগান এতই বিখ্যাত যে এটা নিয়ে গানও আছে এমনকি হালের বলিউডের "গালি বয়" মুভিতেও এই গান যুক্ত করা হয়েছে। 

কানহাইয়া কুমারের আরেকটা গুণ হল তাকে যতবেশি দেশদ্রোহী ট্যাগ দেওয়া হয়েছে, সে তত বেশি সোচ্চার হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে সরকারের দুর্নীতি, অবিচার, ব্যার্থতার বিরুদ্ধে স্পিচ দিয়েছে। ও সবসময় বলে আমি সব সময় সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। আমি কোন অন্যায় করিনি। করলে আপনাদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার পরিবর্তে আমার স্থান জেলখানায় হত। দিল্লি পুলিশ ৩ বছরেও মামলার চার্জশিট না দেওয়ায় কানহাইয়া কুমারের কথাই সত্য প্রমানিত হয়। 

কানহাইয়া কুমারের জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটা কারণ হলো- তার রাজনৈতিক অবস্থান খুব পরিষ্কার। সে বলে আমি একজন ছাত্র। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়ি। তাই জনগনের যেসব প্রশ্ন যা তারা করার সুযোগ পায় না, আমি সেই প্রশ্নই সরকার কে করছি। তাকে একবার একজন প্রশ্ন করেছিল, 'আপনি সব সময় মোদী সরকারের বিপক্ষে কথা বলেন, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে বলেন না কেন?' তার উত্তর ছিল এমন, 'দেশে বর্তমানে বেকারত্ব অনেক, দুর্নীতি সীমাছাড়া। এসব বিষয়ে আমি কাকে প্রশ্ন করব? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদীকে না জওহরলাল নেহেরু কে?' (এটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক)। 

কানহাইয়া কুমারের কাছ থেকে আমাদের ছাত্র নেতাদের অনেক শিখার আছে। কীভাবে জনগণের অধিকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্ন করতে হয়, একজন খুবই গরিব ঘরের সন্তান হয়েও কিভাবে নির্লোভ, সৎ থেকে জনগণের কাছে যাওয়া যায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যায় সেটা কানহাইয়া কুমারের কাছ থেকে শিখা উচিত। কানহাইয়া কুমার এবার লোকসভা নির্বাচনে বেগুসারাই থেকে লড়েছে। এই নির্বাচনী খরচের ৭০ লাখ টাকাও সে ক্রাউড ফান্ডিং এর মাধ্যমে ম্যানেজ করছে। 

সে মূলত তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ছিল। কারণ এই আসনে আছে বিজেপির ফায়ারবিগ্রেড নেতা বর্তমান মন্ত্রী গিরিরাজ সিং, কংগ্রেস জোটের নেতা আরজেডি'র তানভীর হাসান। যদিও নির্বাচনে মোদি ফ্যাক্টর কাজ করেছিল খুব বেশি, কানহাইয়াকে তাই হারতে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটের ব্যবধানে। মানুষ দেশের দূর-দূরান্ত থেকে নিজের গাটের পয়সা খরচ করে কানহাইয়ার সমর্থন করছে। কানহাইয়ার সমর্থনে অনেক বলিউড সেলিব্রেটি যেমন- জাবেদ আখতার, শাবানা আজমী, স্বরা ভাস্কর, প্রকাশ রাজ প্রচারণা করছে। তাছাড়া আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালও তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

আমি কখনো কোন রাজনৈতিক নেতা নিয়ে এত বড় লেখা লেখি নাই। কিন্তু কানহাইয়া কুমারের রাজনৈতিক ভিশন, সততা, আইডোলজি আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। কানহাইয়ার মতো রাজনৈতিক কন্ঠস্বর গরিব-মেহনতি-ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের খুবই দরকার। সেটা ভারত হোক বা বাংলাদেশ বা অন্যকোন দেশ। কানহাইয়া কুমার বিহারের জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির উপরে উঠে ভোটে হয়তো জেতেনি। কিন্ত পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে গরিব মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কানহাইয়ার মতো একটা লোকও যদি সফল হয়, তবে সেটা সকল মেহনতি-নির্যাতিত মানুষেরই বিজয়। তার ভবিষ্যত জীবনের জন্যে শুভকামনা রইল।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা