
ফোন বের করে ছবি তোলার চেষ্টা করছি। হাত জমে যাচ্ছে, বাটনই টিপতে পারছি না। টেম্পারেচার চার ডিগ্রি, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ের ডগায়, হু হু সাইবেরিয়ান বাতাস। রক্ত জমে যাচ্ছে।
"বল তো, কাঞ্চনজঙ্ঘার নাম 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' কেন?" দেশে থাকতেই ভ্রমণসঙ্গী সায়েমকে প্রশ্ন করেছিলাম। সায়েম বলতে পারে নাই। "টাইগার হিলে গিয়ে বলবো, একেবারে কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে।" বলে রেখেছিলাম। আজকে রাত পোয়ালে কালকে ভোরে কাঞ্চনের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে। দার্জিলিং চলে এসেছি আমরা, হোটেলে উঠেছি। ওই আঁকাবাঁকা রাস্তায় করে সাড়ে সাত হাজার ফুট ওপরে ওঠা-বলার মত অভিজ্ঞতা। রাস্তা বেশ পাকাপোক্ত, কিন্তু অপরিসর। পাশাপাশি দুটো জিপের বেশি যেতে পারবে না। গোটা রাস্তা জুড়ে পিচের ওপরে নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি বেঁধে পাথরের টুকরো বসানো। এই জিনিসটা নতুন দেখলাম। ফ্রিকশন বাড়ানোর জন্য করেছে এটা, গাড়ির চাকা যাতে পিছলে না যায়। কোয়ার্টার রাস্তা পেরোতেই অন্ধকার হয়ে গেলো। একে যে জিগজ্যাগ রাস্তা, তার ওপরে এই ঘুরঘুট্টি আঁধার। স্ট্রিটল্যাম্প দেবার তো কোনো উপায় নেই-রাস্তার একপাশে পাহাড়ের খাড়া গা, আরেক পাশে অতল খাদ।
ড্রাইভারের গাড়ি চালানোর অনায়াস ভঙ্গি দেখে মনে হলো বেড়ালের কাছ থেকে চোখ ধার নিয়েছে। অবশ্য তার কাজটা সহজ করে দিয়েছে রাস্তার দুই ধারে খানিক পরে-পরে বসানো হলুদ রিফ্লেকটর, হেডলাইটের আলো পড়তেই ফসফরাসের মত জ্বলে উঠছে। বাঁক আর মোচড়গুলো চিনিয়ে দিচ্ছে। তাও কাজটা কঠিন, অবশ্যই। মোড় ঘুরলেই হুশ করে গাড়ি চলে আসে উল্টোদিক থেকে। ব্রিটিশ আমলে গোর্খারা মরণপন যোদ্ধা ছিলো, এখন তারা স্বাধীন দেশে ফর্মুলা ওয়ান লেভেলের ড্রাইভার হয়ে গেছে। দু তিনশো মিটার এলিভেশনে উঠতেই কানের পর্দা বাদ সাধলো। এমন চাপ দিচ্ছে যেন পর্দা ফুটো করে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে কোনোকিছু। ব্যাপারটা আর কিছুই না, ওপরে ওঠার সাথে সাথে বাতাসের চাপ কমে গেছে এটমোস্ফিয়ারে, কিন্তু পর্দার ভেতরের দিকের চাপ একই আছে। সেই তারতম্যের জন্যই এই অসোয়াস্তি।
আমাদের সাথের এক অফিসার ভদ্রলোকদের একজন "কি হইলো কি হইলো" বলে কানে তর্জনী ঢুকিয়ে প্রবলবেগে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করলেন। "ঢোক গিলুন," বুদ্ধি বাতলে দিলাম। নিজেও গিলছি। ঢোক গিললে ইউস্টেশিয়ান টিউব খুলে যায়, এটমোস্ফিয়ারের সাথে চাপ সমান হয়ে আসে। চট করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো "গ্যাংটকে গন্ডগোল।" ফেলুদা তোপসেকে ঠিক এভাবেই বুদ্ধি বাতলে দিয়েছিলো। আধা রাস্তা পেরিয়ে কার্শিয়ং শহর। সাড়ে আটচল্লিশ শো ফিট ওপরে। ততক্ষণে ল্যান্ড রোভারের কাঁচে হিম জমেছে। ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে, জ্যাকেট পরেছি।
বেশ জমজমাট শহর কার্শিয়াং। দার্জিলিং দেখতে কেমন হবে, আইডিয়া পেয়ে গেলাম। কাঠের বাড়ি, ইংলিশ বাংলো স্টাইলে কাঠের দোচালা ছাদ। সব সাইনবোর্ড ইংলিশে। লোকজন মন্থর পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, গায়ে শীতের জামা। বেশিরভাগই গোর্খা, পাহাড়ি চেহারা। বেশ প্রাণচঞ্চল শহর। হালকা জ্যামেও পড়তে হলো। ট্রাবল ইন প্যারাডাইস। মাইন্ড করলাম না। এখন সবই সুখের। রাস্তার একপাশে তাকিয়ে দেখি, ছোট্ট একটা রেললাইন। মাত্র ফুট দুয়েক চওড়া। মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো আমার। এটাই সেই বিখ্যাত দার্জিলিং-হিমালায়ান রেলওয়ে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। দার্জিলিং এর পৃথিবী বিখ্যাত টয় ট্রেনের নাম শুনেছেন না? এই লাইনেই চলে। কার্শিয়াং পেরিয়ে আরো রাস্তার গোলকধাঁধা পেরিয়ে, আরো অনেক ওপরে উঠে, আরো পাঁচ-ছ'বার কানের তালা ছুটিয়ে দার্জিলিং-এ আসা গেলো! গাড়ি থেকে নেমে এক মিনিট হাঁটতেই ম্যাল! এই সেই ম্যাল। ছোট্টবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছি ম্যালে আসবার। ফেলুদার প্রথম গল্পের প্রথম লাইন কে ভুলবে - "ভদ্রলোককে রোজ বিকেলে ম্যাল-এ আসতে দেখি!" আহ! দ্য বয়হুড ড্রিম হ্যাজ কাম ট্রু।

ম্যাল আসলে একটা চত্বর। বিদেশে যাকে টাউন স্কোয়্যার বলে। বাংলাদেশে কোনো সত্যিকারের স্কোয়্যার নেই, তাই এটাই আমার প্রথম কোনো স্কোয়্যার দেখা। ম্যালের একপাশে খাদ নেমে গেছে, আর বাকি তিন দিকে দোকান পাট। সবচে প্রমিনেন্ট জায়গায় দুটো ঐতিহ্যবাহী দোকান-অক্সফোর্ড বুক শপ আর হাবিব মল্লিক কিউরিও শপ। দুটোই একশো বছরের বেশি পুরোনো।
আমাদের বেলভিউ হোটেলের স্থানমাহাত্মে চমকে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই ম্যালের ওপরে। একদম ওপরেই। প্রমিনেন্ট জায়গা যাকে বলে। তিন তলার একটা রুম ভাড়া করলাম চার বন্ধু মিলে। চার আঙ্কেল পাশের রুমে। রুমটা বেশ। তিনজন শোবার মত বেড, আর একটা ডিভান। কাঠের মেঝে, কাঠের দেয়াল। বেশ খোলামেলাও। ওদিকের দুটো জানালা দিয়ে ম্যালের পুরোটা, আর ঢেউ খেলানো পাহাড় চোখে পড়ে। আমার আবার গোসল না করলে চলে না। তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি, তবু গোসল করতে ঢুকলাম সবার আগে।
গিজার আছে বাথরুমে। না থাকলে আসলে বাঁচাও সম্ভব না। পানির টেম্পারেচার ঠিকঠাক করার জন্য প্রথমে ঠান্ডা পানির ট্যাপটা খুলে হাত দিতেই একেবারে মগজে গিয়ে বাড়ি মারলো হাড় কাঁপানো শীতের ঢেউটা। অসম্ভব, অসম্ভব ঠান্ডা। দেশের শীতলতম এলাকায় থাকি (রংপুরের শীতটা কিন্তু হিমালয়েরই অবদান), তবু কাবু হয়ে গেলাম। পাহাড়ি শীত কাহাকে বলে, কতপ্রকার ও কি কি, শিক্ষা হয়ে গেলো। সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে গায়ে জোব্বাজাব্বা চাপিয়ে বেড়াতে বেরোলাম। ম্যাল থেকে চকবাজারের (বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলায় চক আছে, ভারতেও মে বি একই অবস্থা) দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে রাস্তাটা, সেটা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলাম আরেকটা মোড় পর্যন্ত। রাস্তার দুইপাশে বহু ঐতিহ্যবাহী দোকান-গ্লেনারি'স, দাস স্টুডিও ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই কেভেন্টার্স রেস্টুরেন্ট! এই সেই কেভেন্টার্স, যেটার ছাদে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে হট চকোলেট না খেলে চলে না ফেলুদার। সত্যজিৎও সিনেমার শুটিং করেছেন এর ছাদে। "কালকে আসবো। আজকে ডিনার করে নেই," সায়েমকে বললাম। খিদে লেগেছে। ব্রিটিশরা এই কারণেই দার্জিলিংকে স্বাস্থ্যকর বলতো। এই ছুরির মত ধারালো নির্মল পাহাড়ি হাওয়া খুবই ক্ষুধাবর্ধক! ভোরে উঠলাম সাড়ে তিনটায়। ড্রাইভারকে নাম্বার দেয়া ছিলো, গাড়ি সমেত এসে কল দিয়েছে আমাদের। এই আর্কটিক-মার্কা শীতে লেপের তল থেকে বেরোনোই কষ্ট-কিন্তু আজকের দিনটা তো সাধারণ দিন নয়। আজকে কাঞ্চনের সাথে মুখোমুখি দেখা হবার দিন! চট করে রেডি হয়ে চারটার ভেতরে জিপে চড়ে বসলাম আমরা আটজনই।

আবার সেই রাস্তার গোলকধাঁধা। এবার আরো ওপরে উঠছি। টাইগার হিল হচ্ছে দার্জিলিং শহরের মধ্যে সবচে উঁচু শৃঙ্গ। সাড়ে আট হাজার ফিট। দার্জিলিং হচ্ছে বাহাত্তর শো ফিট। চলতে শুরু করে রাস্তার পাশে বাড়িঘরের ঘনত্ব একটু কমতেই-রাতের আকাশের ওদিকটায় জ্বলজ্বল করছে ওটা কি? বুঝতে পারতেই চমকে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সায়েমও দেখেছে। আমার দিকে ঝুঁকে বললো, "কাঞ্চন!" মাথা ঝাঁকালাম। বরফের লাইট রিফ্লেকশনের পাওয়ার কতটা বেশি, সেটা বুঝতে পারলাম হাতে নাতে। স্রেফ তারার আলোতেই পূর্ণিমার চাঁদের মত জ্বলজ্বল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। নাহ, এখন দেখতে চাই না। টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের আলোয় ঘোমটা তুলবো কাঞ্চনের। আধাঘন্টা লাগে টাইগার হিলে যেতে। প্রচুর গাড়ির ভিড়, বেশ অনেকটা আগেই জিপ পার্ক করতে হলো। এটাই পিক সিজন তো।
নভেম্বরের এই সময়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। টুরটার প্ল্যানও ভেবেচিন্তেই ঠিক করেছি সময়মতো। রেলিং ঘেঁষে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে। আমরাও সামিল হলাম। পূর্ব আকাশে লাল রং, সূর্য উঠছে। উত্তরের আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা! সবচেয়ে আগে যে ব্যাপারটা ইমপ্রেস করলো, সেটা হচ্ছে আকার। বিরাট। নিজ চোখে এমন মহা পর্বত তো কখনো দেখিনি, আজ একটা ধারণা হলো। বিরাট একটা সাদা ঢাল, নেপালকে আলাদা করে রেখেছে ভারত থেকে। ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের সাথে ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেটের টক্করের ফল। সাড়ে আট হাজার মিটার। সাড়ে আট কিলোমিটার উঁচু। বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ফ্রিকিং ইমপ্রেসিভ। অতিকায় না হলে ষাট কিলোমিটার দূরের একটা জিনিসকে এত ঢাউস দেখা যায় না! শেপটাও বলার মতো। একটু আর্টিস্টিক মন নিয়ে তাকালেই দেখতে পাবেন, একজন শুয়ে থাকা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। 'স্লিপিং বুদ্ধা' তো এজন্যই বলে।
ফোন বের করে ছবি তোলার চেষ্টা করছি। হাত জমে যাচ্ছে, বাটনই টিপতে পারছি না। টেম্পারেচার চার ডিগ্রি, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ের ডগায়, হু হু সাইবেরিয়ান বাতাস। রক্ত জমে যাচ্ছে। বুদ্ধি করে আমার সব জামা পরে এসেছি- টি শার্ট, তারওপরে উলের ফুলহাতা, তারওপরে শার্ট, তারওপরে পার্কা, তারওপরে ঢাউস জ্যাকেট। গলায় মাফলার। কানে টুপি। কিন্তু হাতমোজা আনা হয়নি, এবং হাতে ফ্রস্টবাইট হবার জোগাড়। সূর্য উঠছে, আর কাঞ্চনজঙ্ঘা সাদা থেকে আরো শাদা হতে হতে একেবারে শুভ্র যাকে বলে, সেই রংটা ধরলো। হালকা নীলেরও ছোঁয়া আছে। এবং তারপরই শুরু হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমে একদম সূচালো ডগাটায় সূর্যের কিরণ পড়লো, ঝকঝকে সোনালী হয়ে উঠলো জায়গাটা। তারপর ধীরে ধীরে কাঞ্চনের পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়লো সোনা-রং। আমার সামনে এখন এক স্বর্ণ-পর্বত।
দার্জিলিং আর গ্যাংটকের আদিবাসীরা এমনি এমনি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেবতা ভেবে পূজা করতো না। এই সৌন্দর্য আসলেই স্বর্গীয়, আসলেই ঐশ্বরিক। "এবার বোঝ, কাঞ্চনজঙ্ঘা কেন নাম হলো," সায়েমকে বললাম। "গোর্খারা কাংচেংজুংগা বলে, দে হ্যাভ দেয়ার রিজনস, কিন্তু সংস্কৃত নামের একটাই অর্থ। সোনা। কাঞ্চন মানে সোনা।"
০৮.১১.২০১৭ *
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন