বাবা-মা-দাদু-দিদিমা সবাই ছিলেন বিপ্লবী। অল্পবয়স থেকে যিনি নিজেও সংগ্রাম করেছেন নিপীড়িতদের হয়ে। আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত কমলা হ্যারিস, তাঁঁর জীবন গল্পে রয়েছে ঘাত-প্রতিঘাতের অনেক সমীকরণও!

যারা বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে বেশ ভালো ধারণা রাখেন, তাদের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বরাবরই এক মহোৎসবের নাম। কয়েক মিনিটের অসাধারণ ভাষণ দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে এখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চলে আসতে পারেন বারাক ওবামা, হেভিওয়েট হিলারিকে পেছনে ফেলে দিয়ে এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতন 'মাথাগরম' লোকজনও চলে আসতে পারেন। 'বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি' হবার লড়াই' তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এখানে রাজনীতিও হয় খুব উঁচুস্তরের। এবং অঘটন-ঘটন ও বহু চলকের ইশারা-ইঙ্গিতও চলে জোরেসোরেই।

তা এবারের নির্বাচনেও কী কম হলো কিছু? ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'টুইটার-বৃষ্টি' ও নির্বাচন বর্জনের হুমকি, স্যুইং স্টেটস গুলোর স্টান্টবাজি, মাঝেমধ্যেই উল্টেপাল্টে যাওয়া সবকিছু, সবশেষে সাতাত্তর বছরের একজন মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া...এবারের নির্বাচন নাটক মোটেও কম দেখায়নি। যদিও করোনার প্রকোপ ও আমেরিকার আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু সন্দেহ ছিলোই। তবুও সে সন্দেহ কেটে খুব প্রথাগতভাবেই 'অপ্রথাগত কাজকর্ম' এ নির্বাচনেও দেখেছি আমরা। নির্বাচনের পুুুুরো সময় জুড়ে দেখেছি নানারকম চমকও।

তবে এ নির্বাাচনে সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় কমলা হ্যারিস৷ জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পরে আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন যিনি। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন যাকে বেছে নিয়েছিলেন রানিং মেট হিসেবে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর এমনিতেই আমেরিকান মানুষদের হৃদয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে আবেগ বেড়ে গিয়েছিলো। সেখানে জো বাইডেনের এই পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি শেষে এসে বেশ কাজও দিয়েছে। তবে কমলা হ্যারিসের উত্থানের গল্প থেকে জানা যায়, তিনি আমেরিকার মহিলা কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমনি এমনি আসেন নি, বেশ যোগ্য প্রার্থী হিসেবেই এই জায়গাতে এসেছেন তিনি।

ভারতীয়-বংশোদ্ভুত কমলার জন্ম আমেরিকাতেই। কমলার মা শ্যামলা গোপালন এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে গবেষণার জন্যে আমেরিকায় আসেন ষাটের দশকে। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করা শুরু করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা থাকলেও তিনি আর দেশে ফেরেন না। বিয়ে করেন জ্যামাইকা থেকে আসা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ডোনাল্ড হ্যারিসকে। দুজনেই নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই পরিচয়, প্রেম, বিয়ে। ডোনাল্ড ও শ্যামলার প্রথম সন্তানই কমলা হ্যারিস।

কমলার সাত বছর বয়সে বাবা-মা'র ডিভোর্স হয়ে যায়। শ্যামলা তার দুই মেয়ে কমলা ও মায়াকে নিয়ে নিয়ে আলাদা হয়ে যান ডোনাল্ড হ্যারিসের থেকে। তবে বাবার সাথে দুই মেয়ের সখ্যতা কিন্তু কমেনি কোনোদিনই। বরং অটুট ছিলো বরাবরই।

আমেরিকা থেকে  দু’বছরে এক বার ভারতের চেন্নাইয়ের বেসান্ত নগরে দাদু-দিদিমার কাছে আসত কমলা, মায়ের সাথে। দাদুর সাথে সমুদ্র সৈকতে বিকেলবেলা হাঁটতে যাওয়ার স্মৃতি কমলা এখনো চোখ বুজলেই মনে করতে পারেন। দাদু ছিলেন একসময়ের ডাকসাইটে বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী- পি ভি গোপালন। গোপালন পরে উচ্চপদস্থ আমলার পদে আসীন ছিলেন বহু বছর। অবসরের পর বেসান্ত নগরেই থাকতেন তিনি সস্ত্রীক।  তাঁর কাছে অনেকেই আসতো বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা মারার জন্যে। সমসাময়িক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতো। ছোট্ট কমলা দাদুর পাশে বসে পুরোটাই হাঁ করে শুনতো। তখন থেকেই কি রাজনীতির বীজ ঢুকে গিয়েছিলো তার মধ্যে? জানা নেই উত্তর। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো- কমলার দিদিমাও সে সময়ের জনপ্রিয় বিপ্লবী ছিলেন। পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক একটি পরিবেশ পেয়েছিলেন কমলা হ্যারিস।

কমলা হ্যারিসের ছোটবেলা কেটেছে তাঁর মা শ্যামলা ও ছোট বোন মায়ার সাথে। মা স্তন ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করতে সারা পৃথিবী ছুটে বেড়াতেন। দুই বোনও মায়ের সাথে ঘুরতো সারা পৃথিবীতে। এ বিষয়ে একটা মজার ঘটনা হচ্ছে, স্কুলে থাকতে শিক্ষকেরা যখন জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা কে কয়টা দেশ ঘুরেছো, তখন কমলা গড়গড় করে ১০-১৫ টি দেশের নাম বলে দিতেন। শিক্ষকেরা ভাবতেন, এ বোধহয় মিথ্যে কথা বলেছে। কিন্তু পরে জানা যেতো, আসলে ঠিক কথাই বলছে সে। পৃথিবীর এপ্রান্তে-ওপ্রান্তে ঘুরলেও কমলার শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা অংশ কেটেছে কানাডার কুইবেক শহরে। এ শহরের এক হাসপাতালে গবেষণা করতেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন তাঁর মা শ্যামলা। তাই কুইবেকেই প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন কমলা। এরপর আসেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন তিনি। ডক্টরেট করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেস্টিংস কলেজ অব দ্য ল’ থেকে।

হাভার্ডে পড়াশোনা করার সময়ে রাজনীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন বারাক ওবামা। একই ঘটনা আমরা লক্ষ্য করি কমলা হ্যারিসের বেলাতেও। হাভার্ডের ডিবেট সোসাইটি'তেও নিয়মিত ডিবেট করতেন তিনি। আইনজীবী হওয়ারও ইচ্ছে ছিলো। পূরণ করেছেন সেটিও। ১৯৯০ সাল‌ ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যালামেডা কাউন্টির ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে কাজ করা শুরু করেন তিনি। ২০১০ এ এসে তিনি প্রথম মার্কিন-আফ্রিকান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন। এরপর সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে সাত বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবেও ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এত বছরের আইনী জীবনে তিনি বরাবরই সোচ্চার ছিলেন মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। তাঁর রায়ে তিনি কাউকে কখনো মৃত্যুদণ্ড দিতেন না। এবং সবাইকেই নিরুৎসাহিত করতেন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে কথা বলা থেকে৷

২০১৬ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন কমলা, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। তবে এর আগে ২০১২-এ ডেমোক্র্যাটদের ন্যাশনাল কনভেনশনে প্রাইম টাইম বক্তা ছিলেন কমলা হ্যারিস। তখনই তাঁর কথাবার্তা শুনে মানুষজন চমকিত হয়। তাকে নিয়ে আলোচনা, কড়চাও শুরু হয় তখনই। সে সময়ে কমলাকে জনপ্রিয় করার পেছনে ওবামারও বেশ ছোটখাটো এক ভূমিকা আছে। ২০১৩ সালের দিকে এক সম্মেলনে তিনি কমলাকে ‘বাই ফার, দ্য বেস্ট লুকিং অ্যাটর্নি জেনারেল ইন দ্য কান্ট্রি’ বলে অভিহিত করেন। যার কারণে ওবামাকে পরে খানিকটা সমালোচনাতেও পড়তে হয়েছিলো।

যাই হোক, কমলাতে ফিরি। সিনেটর হিসেবে আসার পর গত নির্বাচনেই ডেমোক্রাটিক শিবির থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কথা ছিলো তাঁর। অনেকে হয়তো আশাও করেছিলেন,  কৃষ্ণাঙ্গ কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসবেন এবার। কিন্তু শেষদিকে এসে কমলা নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ক্যাম্পেইন চালালোর মত পর্যাপ্ত টাকাপয়সা ছিলোনা বলেই পিছিয়ে আসতে হয় তাকে।

তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে পিছপা হলেও  ট্রাম্পের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কাজকর্মের বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদ করে এসেছেন তিনি। এ কারণে ট্রাম্পও তাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না।  জো বাইডেন যখন কমলাকে 'রানিং মেট' হিসেবে নির্বাচিত করেন, তখন ট্রাম্প বিষয়টিকে ভয়ঙ্কর হিসেবেও উল্লেখ করেন। আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, কমলা আর বাইডেনের মধ্যে এখন বেশ গলায় গলায় ভাব হলেও, এই সেদিন পর্যন্ত কমলা, বাইডেনেরও বিভিন্ন কাজের বিরুদ্ধে স্পষ্টবক্তা ছিলেন। সিনেটেও বাইডেনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বরাবরই।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস! 

কমলার বয়স তখন খুবই কম। আমেরিকায় সিভিল রাইটস আন্দোলনও তখন তুঙ্গে। বাবা-মা যেহেতু দুইজনেই ছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, তাদের সাথে মেয়েও মাঝেমধ্যে মিছিলে যেতেন। কমলার স্মৃতিতে সে মিছিলের আবছা স্মৃতি মনে আছে আজো। কালো কালো মাথা, পা, হাতে প্ল্যাকার্ড আর স্লোগান। মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে অভিমান করে থাকতো কমলা। মা বলতেন- কী চাও তুমি? কমলা তখন সদ্য সদ্য কথা বলা শিখেছে, সে বলতো- ফিদম!

সেই মেয়েটি দেখতে দেখতে পঞ্চাশোর্ধ এক সচেতন রাজনৈতিক কর্মী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আগামী চার বছরের শাসনতন্ত্রে দেখা যাবে তাকেও। আমেরিকানদের ফ্রিডমের জন্যে তিনি কতদূর কী করবেন, তা সময়ের হাতেই ন্যস্ত। তবে যে দেশে এর আগে কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভুত এবং কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে রানিং মেট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি কেউ, সেখানে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ  মহিলা! উপমহাদেশের সাথে শেকড়ের সম্পর্কে যুক্ত একটি মেয়ে এভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রে, এটা ভাবলে যেন ঘুরেফিরে একটা লাইনই নিউরনে অনুরণিত হতে থাকে-

চাইলে অসম্ভব না কিছুই!
*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা