সমর্থকদের কাছে এতোই প্রিয় ছিলেন, ২০০৯ এ সিটির ১৩০ মিলিয়ন প্রস্তাব দেয়ার পর কয়েক হাজার সমর্থক এসি মিলানের অফিসের বাইরে জড়ো হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সিটিতে যাচ্ছেন না, সমর্থকরা তা আশ্বস্ত হওয়ার পরে তারা সবাই কাকার বাসার সামনে গিয়ে জড়ো হয়, এবং কাকার নামে চ্যান্ট করে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে।
২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী রোমারিও-কে স্কোয়াডে রাখলেন না কোচ লুইজ ফিলিপে স্কলারি। তার বদলে দলে ডাক পেলেন এক আনকোরা তরুণ। হইচই পড়ে গেল মিডিয়া পাড়ায়। কে এই তরুণ প্রতিভা? যাকে নিতে দল থেকে নাম কাটা পড়লো ভ্যাটেরান রোমারিও-র! ব্যাপক সমালোচিত হতে হলো স্কলারিকে। কিন্তু কে জানতো এই তরুণই একদিন বিশ্ব ফুটবল শাসন করবেন। হবেন নিজ জেনারেশন এর অন্যতম সেরা ফুটবলার। হবেন ব্রাজিলিয়ান সেই গোল্ডেন জেনারেশন এর সবচেয়ে তরুণ সদস্য এবং শেষ কিংবদন্তি! সেই তরুণের নাম রিকার্ডো আইজেকসন ডস সান্তোস লেইতে। সময়ের পরিক্রমায় যার নামের সাথে যুক্ত হয়, "কাকা"!
মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছোটোবেলায় অন্যান্য ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মতো খুব একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয়নি তাঁকে। বাবার গাড়ি করেই ফুটবল মাঠে ট্রেনিং করতে যেতেন অধিকাংশ সময়। ব্রাজিলের বিখ্যাত সাও পাওলো ক্লাবের ইয়ুথ একাডেমীতে সুযোগ পান ফুটবলে দারুণ প্রতিভার পরিচয় দিয়ে। তারপর সেখানেই একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন। কিন্তু হয়তো বাস্তবতা একটু নির্মম ও কঠিনই বটে! সুইমিংপুলে পা ফসকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন। এতে পুরো ক্যারিয়ারই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। আট বছর বয়সে ফুটবলের হাতেখড়ি হওয়া কাকা সাত বছর পরে সাও পাওলোর যুবদলের সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করেন। সাও পাওলোর হয়ে তাঁর খেলা খুব অল্প সময়েই নজর কাড়তে সক্ষম ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলান কতৃপক্ষের। অবশেষে ২০০৩ সালে সেই মুহুর্তের অন্যতম ইয়াংস্টার রিকার্ডো কাকাকে ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়ায় ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান।
তারপর বাকিটা ইতিহাসের অংশ। পুরো বিশ্ব ফুটবল খুঁজে পেল নতুন এক তারকাকে। নতুন এক ফুটবল ম্যাজিশিয়ানকে! মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে এক দৌড়ে প্রতিপক্ষের শিবিরে ঢুকে পড়া যার কাছে ছিল খুব সহজ ব্যাপার। দেখলে মনে হতো যেন সবুজ ঘাসের ওপর অপূর্ব প্রজাপতি উড়ছে! কি গতি, কি ড্রিবলিং, কি পাসিং, কি ক্রস, কি চান্স ক্রিয়েট! সবজায়গাতেই তিনি অদম্য, অসাধারণ, অনবদ্য। আর এসব কিছুর পরে একজন আপাদমস্তক প্লেমেকার হয়েও কাকার গোল স্কোরিং এবিলিটি তাঁকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চারশো ম্যাচ খেলে দেড়শো গোলের কাছাকাছি গিয়ে তিনি থেমেছেন। যা যেকোনো মধ্যমাঠের খেলোয়াড় এর জন্য মাইলস্টোন তো অবশ্যই, পাশাপাশি ঈর্ষারও বিষয়।
ডি বক্সের বাইরে থেকে জোরালো ও বাঁকানো শটে দর্শনীয় সব গোল করতেন। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর বিপক্ষে দেয়া গোলটা এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা গোল হিসেবেই বিবেচিত হবে এটা কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়। অনেকে বলে থাকেন কাকা তার প্রাইম টাইমে মেসি, রোনালদোর চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। মিলান ফ্যানরা কাকাকে ভালোবেসে তার নামের আগে বিশেষণ দিয়েছিল "Super Kaka"! মায়েস্ত্রো বিশেষণেও তাঁকে বিশেষায়িত করা হতো।
সমর্থকদের কাছে এতোই প্রিয় ছিলেন, ২০০৯ এ সিটির ১৩০ মিলিয়ন প্রস্তাব দেয়ার পর কয়েক হাজার সমর্থক এসি মিলানের অফিসের বাইরে জড়ো হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সিটিতে যাচ্ছেন না, সমর্থকরা তা আশ্বস্ত হওয়ার পরে তারা সবাই কাকার বাসার সামনে গিয়ে জড়ো হয়, এবং কাকার নামে চ্যান্ট করে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। কাকাও তাদের ভালোবাসার জবাব দেন। যদিও তিনি বলেছিলেন, ক্লাবকে সবপ্রকার সহায়তা করতে তিনি রাজি আছেন। ক্লাব যদি মনে করে, তাঁকে ছেড়ে দিলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে তাতে তিনি ক্লাবের সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানাবেন এবং মেনে নিবেন। পরবর্তীতে তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রেকর্ড ৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে, যার ফলে তৎকালীন ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামী খেলোয়াড়ের তালিকায় তিনি উঠে আসেন।
একজন ফুটবলার হিসেবে কাকার ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কোনো কিছুর অভাব নেই। যা যা জেতা সম্ভব প্রায় সবই জিতেছেন। হয়েছেন ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার, জিতেছেন ব্যালন ডি অর। ঝুলিতে আছে চ্যাম্পিয়নস লীগ, ঘরোয়া লীগ এবং স্বপ্নের বিশ্বকাপও! বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লীগ ও ব্যালন ডি অর জেতা নগণ্য খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি অন্যতম, যা তার প্রাপ্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে কাকা একমাত্র ফুটবলার যিনি মিডফিল্ডার হয়েও এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এসি মিলানের হয়ে দুইবার ইতালিয়ান লীগ 'সিরিআ'-তে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি জাতীয় দলের হয়েও তাঁর দলগত প্রাপ্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রাপ্তিও ষোল আনা। ব্রাজিলের হয়ে ২০০৯ এর কনফেডারেশন কাপে সেরা খেলোয়াড়। ২০১০ বিশ্বকাপে ছিলেন সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন এবং টুর্নামেন্টের টপ এসিস্ট প্রোভাইডার হয়েছিলেন। যদিও একটি গোলও করতে না পারার ব্যর্থতায় তাঁকে অনেকেই টুর্নামেন্টে ফ্লপ খেলোয়াড়ের তকমা দিতে চাই, অথচ একজন মিডফিল্ডার হিসেবেই তাঁর কাছ এসিস্টই প্রাপ্য ছিল দলের৷ কিন্তু মিডফিল্ডার হলেও, নামটা কাকা বলেই হয়তো বিশেষজ্ঞ ও দর্শকমনে গোলের চাহিদা ছিল প্রবল।
২০১০ এ মিলানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং কিংবদন্তী হওয়ায় সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে ক্লাবের "হল অফ ফেম" এ জায়গা পান, মাত্র ২৮ বছর বয়সেই! তবে অদ্ভুত হলেও সত্যি, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, রিকার্ডো কাকা বিশ্বজুড়ে তার জনপ্রিয়তা ও মাঠে অনবদ্য পারফরমেন্স এর কারণে ২০০৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন এ বিশ্বের "সবচেয়ে ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তি"র তালিকাতেও জায়গা পেয়েছিলেন! তাও একবার না, ২০০৯ সালেও টানা দ্বিতীয়বারের মতো সেই তালিকায় জায়গা পেয়েছিলেন তিনি! পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এথলেট এর তালিকায় ইএসপিএন তাকে আঠারো নাম্বার পজিশনে রেখেছে। জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম 'টুইটার'-এ সর্বপ্রথম কোনো ফুটবলার হিসেবে দশ মিলিয়ন ফ্যান ফলোয়ার ছাড়ায় তাঁর।
'He was the best player in the world, there was nothing he couldn’t do." — Brazilian legend Ronaldinho on Kaká. ব্লিচার রিপোর্ট বছর দুয়েক আগে তাঁকে নিয়ে দারুণ একটি আর্টিকেল করে, যার চুম্বক অংশ ছিল এমন, "At the end of Kaka's solo dribbles, there came real genius in execution. A perfectly weighted pass between defenders is tough enough to do at the best of times, but to do so on the run, after a 30-metre sprint, often off-balance due to being challenged, is an act of creativity reserved only for the best."
দেয়ার ছিল আরো অনেক কিছুই। হয়তো দিতে পারতেন অনায়াসে, যদি অভিশপ্ত ইঞ্জুরি বাধা হয়ে না দাঁড়াতো। শুভ জন্মদিন রিকার্ডো কাকা। ভালো থাকবেন ফুটবল গ্রেট রিকার্ডো কাকা! আপনি সমর্থকদের মনিকোঠায় থাকবেন চিরদিন। সেই আবেগ এবং ভালোবাসার কোনো অবসর নেই, তা চিরন্তন!