কাচ্চি মানেই বিশেষ ভালোবাসা। চরম শত্রুও যদি কাচ্চি খেতে এক টেবিলে ডাকে, বাঙালি বোধহয় হাসিখুশি মনেই সেখানে যোগ দেবে। কীভাবে কাচ্চি এতটা জনপ্রিয় হলো?
'কাচ্চি', নামটা শুনলেই যেন শরীরে অন্যরকম ভাব চলে আসে। পেটের ক্ষুধা যতগুণ বাড়ে, মনের ক্ষুধা বেড়ে দাঁড়ায় তার চাইতে বেশি। এরপর খেতে যাওয়া হয়, খাওয়া শেষে বুকে উঠে অন্যরকম হাপিত্যেশ! তখন মনে হয় এটা কী খেলাম! ব্যাপারটা এমন যে খেয়েও পস্তাইলাম, না খেলেও পস্তাইতাম।
আসলে কাচ্চি সম্ভবত একমাত্র খাবার, যেটা বাঙালি শতভাগ 'এক্সপেক্টেশন' নিয়ে খাওয়া শুরু করে। তিল পরিমাণ ভুল হলে, ব্যাপারটা তাল হয়ে যায়! আলু পোড়া হলো কেন, ছোট হলো কেন, মাংস নরম হলো না কেন, বিরিয়ানিতে মশলাটা ঠিকঠাক মিশেনি কেন... অল্পতেই অভিযোগের তালিকা যেন শেষ থাকে না। অনেকে তো এক দুই কদম এগিয়ে, একটু হেরফের হলেই গন্ডগোল পাকিয়ে দেয়। বরং এমন বাঙালি একদম খুঁজে না পাওয়া দায়। যেন মনে হবে, আর কোনো খাবার বাঙালি এতটা মনোযোগ দিয়ে খায় না আরকি।
তবে এই প্রচন্ড 'রিচ ফুড' ক্যাটাগরি'র খাবার বাঙালির খাদ্য অভ্যাসে মিশে গেল কীভাবে বা কীভাবেই এটা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পরিণত হলো তা খানিকটা জেনে নেয়া যাক।
কাচ্চি শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ 'কাঁচা', ভারত ও পাকিস্তানেও এই বিরিয়ানি উর্দু শব্দ 'কাচ্চা' হিসেবেই পরিচিত। সুগন্ধি বা বিরিয়ানি চালের সাথে সরাসরি সেদ্ধহীন মাংস ও আলু মিশিয়ে, দই-মাখন, বেশ পরিমাণ স্থানীয় মশলার মিশেলে মাংসের ওপর চাল ও আলুর আস্তরণ তৈরি করে এটি রান্না করা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, মধ্য এশিয়াতে এই বিরিয়ানির প্রচলন সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিলো। সাধারণত তুর্কেমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানের লোকেরা খাসি বা ভেড়া তথা লাল মাংস ব্যবহার করে এই বিরিয়ানির রান্নাকে পূর্ণতা দিতেন৷
প্রখ্যাত শাসনকর্তা তৈমুর লং এর শাসনামলের শেষেই কাচ্চি বিরিয়ানি অত্যাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ আর উপমহাদেশে কাচ্চির আমদানি ঘটে মুঘল শাসনামলে। মুঘলরা সাধারণত মধ্য এশিয়া হতেই আগত। সময়ের পরিক্রমায় বাংলার ঢাকাতেও মুঘলদের পদচারণা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিযুক্ত সুবেদারেরা নিজেদের সঙ্গী হিসেবে রাঁধুনি নিয়ে আসতেন। এদের হাত ধরেই ঢাকায় এই বিরিয়ানি তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে জনসাধারণের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসকল রাজকীয় বাবুর্চিরা উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে এসেছিলেন।
এরপরে কাচ্চির ইতিহাস কেবলই সমৃদ্ধি এবং বাঙালির ঐতিহ্য ও খাদ্য সংস্কৃতিতে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয়ার। তবে সময়ের আলোচনায় বলতে হবে, বাংলাদেশের অন্য স্থান নয় বরং পুরান ঢাকার বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবেই কাচ্চি দীর্ঘদিন সীমাবদ্ধ থেকেছে এবং এখনো সেই বিরিয়ানি রাজকীয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। কাচ্চি শব্দটির আগে 'পুরান ঢাকা' শব্দদয় বরং বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটিও তীব্র সত্য যে, কাচ্চি এখন আর পুরান ঢাকা ঐতিহ্যবাহী হিসেবে কেবল সীমাবদ্ধ নেই। এটি ক্রমাগত নতুন ঢাকার নব আভিজাত্যে পরিণত হয়েছে এবং ঢাকা বিভিন্ন দিকসহ দেশব্যাপী প্রসার লাভ করেছে।
মাত্র বছর কয়েক আগেও কাচ্চি বলতেই আমরা পুরান ঢাকার নান্না, হানিফ বিরিয়ানি, রয়েল, কলকাতা কাচ্চি বা ছোট ছোট কাচ্চি ঘর, স্টার কাবাব এসকলকে বুঝতাম। কিন্তু ইদানীং সেই প্রতাপকে ছাপিয়ে হাল আমলের সুলতান ডাইন, কাচ্চি ভাই, কাচ্চিওয়ালা, মুঘল এম্পায়ারের উত্থান আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। সালাম'স কিচেন, ট্রেডিশন বিডি, গ্র্যান্ড নওয়াবও এই তালিকায় আছে, যদিও এগুলো তুলনামূলক পুরোনো কাচ্চি হাউজ। সবমিলিয়ে বর্তমান এসব কাচ্চি হাউজগুলোই তরুণদের পছন্দের জায়গায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
কাচ্চির স্বাদ পাওয়ার জন্য, নাজিরা বাজার, চানখারপুল, বেচারাম দেউরি, লালবাগ যেতেই হবে এই দিব্যির প্রবণতা বেশ খানিকটা লোপ পেয়েছে। ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা, গুলশান, খিলগাঁও সবখানেই নব্য কাচ্চি হাউজগুলো একের অধিক ব্রাঞ্চের মাধ্যমে চাহিদার প্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলেছে। বরং নান্নার আসল নকল ব্রাঞ্চ খুঁজতে হয়রান, অস্বাভাবিক জ্যামের প্রকোপে দিন দিন পুরান ঢাকা বিমুখ হয়ে উঠেছে নতুন ঢাকার অধিবাসীরা। তবে এতে পুরান ঢাকার কাচ্চি ব্যবসা মন্দ যাচ্ছে তা ভাবার জো নেই৷ কারণ স্থানীয় মানুষের চাহিদা মেটাতেই সেসব কাচ্চি হাউজ সাধারণত হিমশিম খায়।
আর অবশ্য মানতেই হবে, কাচ্চির মধ্যেও বিভিন্নতা এসেছে বটে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হলো কাচ্চির চালে। পুরান ঢাকার লোকদের কাছে জানতে চাইলে বুঝবেন, কাচ্চি মাত্রই চিনিগুড়া চাল ও খাসির হতে হবে। এর বাইরে আলু তো আছেই, সাথে টিকা আর বোরহানি থাকলে আরো জমে ক্ষীর! তবে নতুন ঢাকার নব আভিজাত্যে, বাসমতী কাচ্চির চাহিদা বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। হয়তো ঘরে কম খাওয়ার পাশাপাশি বাঙালি কেন জানি একধরনের রাজকীয়তা খুঁজে পায় এই চালে! তাই মেন্যু, ব্যানার কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট... সবখানেই কাচ্চিপ্রেমীদের আকর্ষণের স্বার্থে 'বাসমতী' শব্দটার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়। সেট মেন্যুর আদলে সাইড ডিশ হিসেবে টিকা বা মুরগির রোস্টের সাথে বিফ রেজালাও যুক্ত করা হচ্ছে।
এভাবেই কাচ্চি উপভোগের ধরনে সুক্ষ্ম কিন্তু ফলপ্রসূ উদাহরণ আমরা লক্ষ্য করছি। এর বাইরেও গরু বা চিকেনের কাচ্চিও আজকাল ঢাকায় অলিগলিতে অহরহ মিলছে! নতুনত্বের খোঁজে মানুষ সেগুলোও গ্রহণ করতে পিছপা হচ্ছে না। সুতরাং বলতেই হবে, পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ কাচ্চি একধরনের পরিবর্তনমূলক নবধারার মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। যা সাধারন কাচ্চিপ্রেমী হিসেবে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে নতুন নতুন গবেষণা আসাটাই স্বাভাবিক নয়কি!
কাচ্চি বিরিয়ানি মাত্রই বিশেষ ভালোবাসা। চরম শত্রুও যদি কাচ্চি খেতে এক টেবিলে ডাকে, বাঙালি বোধহয় হাসিখুশি মনেই সেখানে যোগ দিবে। তবে চাইবো, অতি গবেষণা ও চাহিদায় কাচ্চি বিরিয়ানি যাতে আবার মৌলিকত্ব হারিয়ে না ফেলে! কারণ বিরিয়ানি তো ঢেরভাবে বানানো যায়, কিন্তু কাচির বিশেষত্বই তো এর বানানোর মৌলিক প্রক্রিয়া!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন