গ্ল্যামার নেই, তাই হয়তো পাটকল শ্রমিকের মৃত্যুতে শোকগাঁথা নেই!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তারা বলছেন, নিয়মিত মজুরি না পাওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া দিতে না পারা– এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আমরণ অনশনে বসেছেন শ্রমিকরা।
যে শ্রমিকদের কথা কেউ বলে না, সেই পাটকল শ্রমিকরা নিজেদের দাবি নিয়ে অনশন করেছিলেন। কিন্তু, তাদের এই আন্দোলন যেন পাত্তাই পেলো না আমাদের নিত্যদিনকার নাগরিক সমাজে। আমরা কথা বলি কত কিছু নিয়ে, কিন্তু পাটকল শ্রমিকদের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছায় না। খুলনায় পাটকল শ্রমিকদের জীবনে অস্থিরতা বিরাজ করছে অনেকদিন ধরেই। এর আগেও তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। এবারও নামলেন। নিয়মিত মজুরি পরিশোধ সহ ১১ দফা দাবি ছিল তাদের। তারা বলছেন, নিয়মিত মজুরি না পাওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া দিতে না পারা– এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আমরণ অনশনে বসেছিলেন শ্রমিকরা। এই শীতের দিনে রাতে তারা দাবি আদায়ের জন্যে এইরকম কষ্ট করে গেলেন। কিন্তু, কারো কি মন গলেছে? বিবেকে ধাক্কা লেগেছে?

কারো মস্তিষ্কে অনুরনন তৈরি করতে না পারলেও জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে একজন শ্রমিকের। অনশন করতে করতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া শ্রমিক আবদুল সাত্তার মৃত্যুবরণ করেন। তাকে খুলনা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁচানো গেলো না। যেমন বাঁচানো যাচ্ছে না পাটকলগুলোকে, যেমন ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছেন পাটকলের শ্রমিকরা।
৫৮ বছর বয়সী আবদুল সাত্তারের মৃত্যুকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান দেখছেন, অসুস্থজনিত মৃত্যু হিসেবে। সেই অসুস্থতার উৎস যে দাবি আদায় করতে গিয়ে অনশন করা, তা তো মন্ত্রী জানেন, তাই নয় কি! মন্ত্রী আবদুল সাত্তারের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু, এই অনশনে বসা শ্রমিকদের দিকে নজর দিলে, তাদের এতোদিনের ক্ষোভের জায়গায় একটু পরশ বুলিয়ে দিলে হয়ত পাটকল শ্রমিক আবদুল সাত্তারের এই করুণ মৃত্যু এড়ানো যেত।
উল্লেখ্য, সব সেক্টরের মজুরি কমিশন থাকলেও নেই পাটকল কেন্দ্রিক মজুরি কমিশন। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল কর্পোরেশন শ্রমিকদের জন্য জাতীয় মজুরি কমিশন ২০১৫ ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি এখনো। এর আগে এবছর মে মাসেও পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। তারও আগে আরো কয়েকদফা তাদের পথে নামতে হয়েছিল। তারা কি চান আসলে? খুব বেশি কিছু কি? শুধু তারা একটু বেঁচে থাকতে চান৷ তারা চান তাদের বকেয়া বেতনগুলো দেয়া হোক, তাদের মজুরিগুলো যথাসময়ে তারা পান। কিন্তু, এই দাবিগুলো বার বার বার জানিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
সরকারি পাটকলগুলোতেই কেন এই অচলায়তন? জানা যায় এখানেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারকে লোকসান দিতে হচ্ছে। এছাড়া সরকারি পাটকলে উৎপাদনশীলতা কম, যন্ত্রপাতিও অনেকদিনের পুরানো, নেই আধুনিকায়নের চেষ্টা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। তারপর গত অর্থ বছরে লোকসান হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। এবছরও ৬০০ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা। কেন এভাবে চলছে সরকারি পাটকল? কেনো এতোগুলো শ্রমিকের জীবন এখনো অনিশ্চয়তায়?
একজন শ্রমিক আবদুল সাত্তারের মৃত্যু নাগরিক সমাজে আলোড়ন তুলতে না পারলেও, এই দেশে হাজার হাজার পাটকল শ্রমিকের জীবনের দুর্দশার প্রতীক এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুটি। কাঙ্ক্ষিত জীবন তাদেরকে রাষ্ট্র উপহার দিতে পারছে না, জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না বলে আজ পাটকল শ্রমিকদের পথে পথে ধুঁকতে হচ্ছে। জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ার এই খেলা থেকে কি রেহাই পাবেন পাটকল শ্রমিকরা?