জাস্ট ফন্টেইন- বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের অনন্ত আক্ষেপ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
১৯৫৮ বিশ্বকাপে এতটাই সর্বগ্রাসী প্রভাব ছিল পেলে ও ব্রাজিলের, যে আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা পারফর্মার। তিনি জাস্ট ফন্টেইন। ফরাসী ভাষায় নামটা একটু বিদঘুটে, জ্যাস্ট ফন্টেইন।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে আছে ব্রাজিলের জেতা প্রথম বিশ্বকাপ হিসেবে। শুধু শিরোপা জয় নয়, পেলে, গারিঞ্চা, নিলটন সান্তোস, দিদি, ভাভা, মারিয়ো জাগালোর সেই ড্রিমটিম এখনও ব্রাজিলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা হিসেবে খ্যাত। তরুণ পেলে সেবার সবমিলিয়ে করেছিলেন ৬ গোল, কিন্তু আসর মাত করেছিলেন সঠিক সময়ে স্কোর করে। এতটাই সর্বগ্রাসী প্রভাব ছিল পেলে ও ব্রাজিলের, যে আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা পারফর্মার। তিনি জাস্ট ফন্টেইন। ফরাসী ভাষায় নামটা একটু বিদঘুটে, জ্যা ফতে। হ্যাঁ, লা ব্লুজের হয়ে সেবার ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন ফন্টেইন।
ফন্টেইন ঠিক ফরাসী নন। বেশিরভাগ ফ্রেঞ্চ লিজেন্ডদের মত ফন্টেইনও জন্মেছিলেন অন্য এক দেশে, মরক্কোতে। তাঁর ক্যারিয়ার শুরু ক্লাসাব্লাঙ্কার এক স্থানীয় ক্লাবে। পরে ক্রমে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু করেন ফরাসী ক্লাব নিসের হয়ে, তিন মৌসুমে করেন ৪৪ গোল। তাঁর ক্যারিয়ার গতি পায় যখন তিনি পাড়ি জমান স্ট্যাডে ডি রিমে। সেখানে তিনি পেয়েছিলেন পরবর্তীকালের রিয়াল লিজেন্ড রেমন্ড কোপার (ডি স্টেফানো ও পুসকাসের গোল্ডেন টিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ) সংসর্গ। রিমসের হয়ে ১৩১ ম্যাচে করেছিলেন ১২২ গোল, দুর্দান্ত রেকর্ড। দুইবার লীগ জিতেছিলেন, ১৯৫৮-৫৯ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালেও খেলেছিলেন, টুর্নামেন্ট সেরা ১০ গোলও করেছিলেন। তবুও হার মেনেছিলেন রিয়ালের কাছে, হয়তো নিয়তিই এমন ফন্টেইনের।
ফন্টেইনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ছোট হলেও বেশ সমৃদ্ধ। মাত্র ২১ ম্যাচে করেছেন ৩০ গোল। তবে তিনি স্মরনীয় হয়ে আছেন ৫৮ বিশ্বকাপে তার পারফর্মেন্সের জন্য। ৫৮ র সুইডেন বিশ্বকাপে ফন্টেইন গিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে। লীগে ৩৪ গোল করেছিলেন মাত্র ২৬ ম্যাচে। জিতেছিলেন লীগ আর কাপসহ ফ্রেঞ্চ ডাবল। আর ছিলেন ততদিনে মাদ্রিদে পাড়ি জমানো রেডমন্ড কোপা। কোপা ছিলেন পারফেক্ট নাম্বার টেন। আর ফন্টেইন ছিলেন সময়ের সবচেয়ে প্রোলিফিক স্কোরার। বছরের শেষে ইঞ্জুরিতে পড়েন ফন্টেইন, বিশ্বকাপের ঠিক আগে একেবারে সতেজ হয়ে ফেরেন। এই জুটিকে ঘিরে তাই স্বপ্ন দেখছিল ফ্রান্সের আপামর জনগণ। হতাশ করেননি তারা। দুজনের মধ্যে যেন ছিল টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ, তাদের দারুণ বোঝাপড়ায় টুর্নামেন্টজুড়ে ভেঙে পড়ে একের পর এক রক্ষণদূর্গ।
গ্রুপের প্রথম ম্যাচ ছিল প্যারাগুয়ের সাথে। প্যারাগুয়ে তখন ছিল ডিসেন্ট একটা দল। ফ্রান্সের সামনে স্রেফ উড়ে যায় তারা, বিদ্ধস্ত হয় ৭-৩ গোলে। ফন্টেইন পেয়েছিলেন হ্যাটট্রিক। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালি যুগোস্লাভিয়া, তখনকার ইউরোপের অন্যতম পরাক্রমশালি দল। যুগোস্লাভদের কাছে হেরে যায় ফ্রান্স। ৩-২ স্কোরলাইনের ম্যাচে দলের পক্ষে দুটি গোলই করেন ফন্টেইন। শেষ পর্যন্ত স্কটিশদের সাথে ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে পরের রাউন্ডে যায় ফ্রান্স। এই ম্যাচেও গোল করেন ফন্টেইন। গ্রুপপর্ব শেষে তার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ গোল। তখন ম্যাচ জিতলে পাওয়া যেত দুই পয়েন্ট। তাই দুই জয় নিয়েও গ্রুপে রানারআপ হয় ফ্রান্স, অন্যদিকে দুই ড্র করেও যুগোস্লাভিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় পরবর্তী রাউন্ডে। এরপরের ম্যাচে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের সামনে পড়ে নর্দান আয়ারল্যান্ড। এই ম্যাচেও তার জোড়া গোলের সুবাদে ৪-০ গোলে জয় পায় ফ্রান্স।
সেমিতে ফ্রান্সের সামনে পড়ে ব্রাজিল। এই ব্রাজিলের সামনে দাঁড়াতে পারার কথা নয় ফ্রান্সের। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে ভাভার গোলে আরো ব্যাকফুটে চলে যায় তারা। তারপরও আক্রমণ চালিয়ে যায় দল, সাফল্যও পায়। ম্যাচের নবম মিনিটে দুর্দান্ত বিল্ডাপ থেকে স্কোর করেন ফন্টেইন। গার্ডিয়ানে লেখা হয়েছিল, “One has never seen a finer goal”. এরপর আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে ম্যাচটি জমে উঠলেও গোল পায়নি কোন দল। এই অবস্থায় ম্যাচের ৩৬ মিনিটে ঘটে সেই ঘটনা। ভাভার ট্যাকলে পা ভেঙে যায় ফরাসী ক্যাপ্টেন রবার্ট জংকের। সেই সময়ে ম্যাচে সাবস্টিটিউশনের কোন সুযোগ ছিল না। তাই ম্যাচের বাকি সময় ভাঙা পা নিয়ে খোঁড়াতে থাকেন ফরাসী ক্যাপ্টেন। এই ঘটনায় মনোবল ভেঙে যায় ফ্রান্স দলের, দলও হয়ে পড়ে দশ জনের, এরপর আর পেরে ওঠেনি ব্রাজিলের সাথে। ম্যাচ হয়ে পড়ে একপেশে। ৫-২ গোলে ম্যাচ জেতে ব্রাজিল। টুর্নামেন্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৯ গোল করেও দলের বাদ পড়া ঠেকাতে পারেননি ফন্টেইন।
এরপরেও ফন্টেইনের সামনে ছিল আরেকটি ম্যাচ, জার্মানীর বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। ফন্টেইনের সামনে ছিল ব্যক্তিগত অর্জনের হাতছানি। এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছিল হাংগেরির স্যান্দর ককসিসের দখলে, আগের বিশ্বকাপে ১১ গোল করেছিলেন ককসিস, তাকে পেছনে ফেলতে ৩ গোল করতে হত ফন্টেইনকে, জার্মান রক্ষণের সামনে যা ছিল বেশ কঠিন। ফন্টেইন করলেন ৪ গোল। ৬-৩ এ ম্যাচ জিতলো ফ্রান্স। সেই সাথে ইতিহাস গড়লেন ফন্টেইন। করলেন এক বিশ্বকাপে ১৩ গোলের রেকর্ড। এমনি এক রেকর্ড, যা এখনো ভাঙতে পারেনি কেউ, ভবিষ্যতেও যে পারবেন, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
মজার ব্যাপার হল, এই যে রেকর্ড গড়েছিলেন ফন্টেইন, সেটা নিজের বুট দিয়ে নয়, ধার করা বুট দিয়ে। ফন্টেইন পরে বলেছিলেন, তার ছিল একজোড়া বুট, যেটা ফেটে গিয়েছিল ট্রেনিংয়ের সময়। তখন স্পন্সর ছিল না, তাই ফন্টেইন ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন। শেষ পর্যন্ত দলের ব্যাকআপ স্ট্রাইকার স্টিফেন ব্রুয়ে তার বূটজোড়া ছেড়ে দেন ফন্টেইনের জন্য। ফন্টেইন অনেকবার বলেছেন, এই বুটে জড়িয়ে ছিল দুজনের স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা।
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা মিরোস্লাভ ক্লোসা, চারটি বিশ্বকাপ খেলে করেছিলেন ১৬ গোল। সেখানে এক বিশ্বকাপেই ১৩ গোল করেন ফন্টেইন। কিন্তু আরেকটা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ তার হয় নি। দুটো বড় ইঞ্জুরিতে মাত্র ২৭ বছর বয়সে শেষ হয়ে যায় তার ক্যারিয়ার। ফন্টেইন হয়ে থাকেন বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে অনন্ত আক্ষেপের নাম।