বিচারপতিদের 'বিব্রত বোধ', ট্রান্সপারেন্সি ও কিছু প্রশ্ন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বিব্রত হবার কারন না জানা থাকলে আমরা ভেবে নেই 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় টাকা খাইসে', 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় সরকারের কথায় উঠ-বস করে', 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় পলিটিকালি ভেতরে ভেতরে ইনভল্বড', ওহ এই বিচারপতি মনে হয় অমুক দল করে-তমুক দল করে'...
আমরা প্রায়-ই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের (হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগ উভয়-ই) বিব্রত হবার কথা শুনতে পাই। অমুক শুনানি শুনতে তমুক বিচারপতি বিব্রত হয়েছেন, তমুক বিচারপতি অমুকের শুনানী শুরুর আগেই বিব্রত হয়েছেন ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিব্রত হওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এই বিব্রত বা 'Embarrassed' ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের জন্য বুঝতে পারা খুব দূরহ ব্যাপার।
বাংলাদেশে সাধারণত বিচারপতিরা একটি মামলার শুনানীতে বিব্রত বোধ করলে সেটি তাঁরা কি কারনে বোধ করেছেন এটি বলেন না। ব্যাপারটা রিজার্ভ রাখেন। এখানে জবাবদিহিতার খুব একটা বালাই আছে বলেও মনে হয়না অথচ একজন বিচার প্রার্থীর কিন্তু অধিকার থেকেই যায় যে রাষ্ট্রের একজন এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ও বিদ্বান কর্মচারী তাঁর বিব্রত হবার কারন স্পস্ট করে আদালতে বলবেন।
বিচারপতিদের এমন বিব্রত হবার কারনে বাংলাদেশের বহু বিচার প্রার্থীর মামলা ঝুলে গেছে বছরের পর বছর। একজন বিচারক বিব্রত বোধ করলে এটিকে তাঁর অধিকার হিসেবেই ধরে নেয়া হয় কিন্তু মাঝে মাঝে এইসব বিব্রত হবার ঘটনা এমন এমন সব মামলায় ও প্রেক্ষিতে হয় যখন সেটি যে রাজনৈতিক এবং স্পষ্টত এটি যে একধরনের বিচার বিভাগীয় গুন্ডামি সেটা সাধারণ নাগরিক দেখলে বা শুনলেই বুঝতে পারেন।
আপনারা এরই মধ্যে হয়ত জানেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মামলায় বিচারপতিদের এমন বিব্রত হবার কারনে সূপ্রীম কোর্টে শুনানী পিছিয়ে গেছে মাসের পর মাস।
আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে খোদ আওয়ামীলীগ যখন ২০০০ সালে ক্ষমতায় তখন বিচারপতি আমিরুল কবির ১০-ই এপ্রিল এই মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনতে বিব্রত বোধ করেন। ২০০০ সালের ২৪ শে এপ্রিল এই মামলা বিচারপতি আব্দুল মতিন ও বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের বেঞ্চে গেলে তাঁরাও শুনতে বিব্রত বোধ করেন। এত বিব্রতবোধ আর বিব্রতবোধের খেলায় শেষ পর্যন্ত ২৮ শে জুন ২০০০ সালে হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে শুরু হয় শুনানী।
এই যে আমি উপরে লিখেছি 'আপনারা শুনলে অবাক হবেন' বাক্যটি সেটারও একটা ব্যখ্যা দরকার। সাধারণত বাংলাদেশের সোশিও-পলিটিকাল বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে সরকার প্রধানের বাবার হত্যাকান্ডের বিচারের শুনানীতে একজন বিচারপতির বিব্রত হওয়া মানে হচ্ছে সেই বিচারপতি নিজেকে সরকারের তোপের মুখে ফেলে দিলেন।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য এইসব বিচারপতিদের বিব্রত হবার পরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনকে বা বিচার বিভাগকে তাঁদের নিজস্ব বিব্রত হবার অধিকারের উপর ছেড়ে দিয়েছেন এবং পার্লামেন্ট বা এক্সিকিউটিভ জুডিশিয়ারির উপর খড়্গ চালায়নি। যদিও বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে কেন এইসব বিচারপতি বিব্রত হলেন তার একটি ব্যখ্যা জানতে পারলে সবারই মনের ভেতরে জন্মানো ক্ষোভটা কিছু হলেও কমতো।
বঙ্গবন্ধুর মামলাতে হাইকোর্টের এই বিব্রত হওয়াই শেষ বিব্রত হওয়া নয়। ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বি এন পি আমলে এই মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। এই সময় বিচারপতি গোলাম রব্বানি, বিচারপতি বি আর মোদাচ্ছির হোসেন, বিচারপতি কে এম হাসান, বিচারপতি আবু সাঈদ আপিলের শুনানিতে বিব্রতবোধ করে ফলে এক পর্যায়ে পুরো মামলাটিকে কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
বিএনপি আমলে বিচারপতিরা বিব্রতবোধ করায় এটিকে আমি একটি রাজনৈতিক চাল হিসেবে বলতে পারি, ইনফ্যাক্ট আমার মনে এমন চিন্তার-ই উদয় হয়। কিন্তু একই কাজ যখন খোদ আওয়ামীলীগ আমলে সূপ্রীম কোর্টের বিচারপতিরা করেছেন ফলে এটি নিয়ে আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে আমার জবাব দেবার কিছুই থাকেনা ফলে বি এন পি আমলে বিচারপতিদের এই বিব্রত হবার ব্যাপারটিকেও আমি বিচারপতিদের নিজস্ব ইচ্ছার বা অধিকারের প্রতিফলন হয়েছে এমনটি ধরেই বুঝে নিচ্ছি বা ধরে নিচ্ছি।
সাধারণত বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী একজন বিচারপতি কোনো মামলার শুনানীতে বিব্রতবোধ করলে সেটির কারন তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে বলেন তবে আজ পর্যন্ত আমরা সাধারণ নাগরিক জানতে পারলাম না এইসব বিব্রত হবার পেছনের কারন।
বিচারপতিদের এইসব বিব্রত হবার অনেকগুলো কারন রয়েছে বলে মনে করা হয়। যেমন বিচার প্রার্থীর সাথে যদি বিচারপতির কোনো আত্নীয়তা, ব্যবসায়িক বা যে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকে যার ফলে উক্ত বিচারপতি মনে করেন এই বিচারে একধরনের 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' রয়েছে যেটি মামলার ক্ষতি করতে পারে কিংবা এক ধরনের পক্ষপাত সে সময় সুষ্ঠ বিচারের স্বার্থে বিচারপতি বিব্রত হয়েছেন বলে সে ই শুনানীতে অপারগতা জানাতে পারেন।
এমন সম্পর্ক ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে একজন বিচারপতি বিব্রত হতে পারেন। যেমন ধরা যাক একজন বিচারপতি কোনো এক সময় আইনজীবি হিসেবে কাজ করবার সময় মাজদার হোসেন মামলায় ড্রাফট করেছেন কিংবা সেই মামলায় আইনজীবি হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।
এখন অনেক বছর পরে সেই আইনজীবি বিচারপতি হবার পর সেই মামলা যদি তাঁর বেঞ্চে শুনানীর জন্য আসে, সেক্ষেত্রে তিনি এমন অবস্থায় বিব্রত বোধ করতে পারেন। কেননা এই মামলার একসময় তাঁর স্বার্থ ছিলো ফলে এই মামলার বিচারকার্যে তিনি থাকলে পক্ষপাতিত্ব করবার আশংকা থেকেই যায় এবং ন্যায়বিচার এই ক্ষেত্রে ব্যহত হতে পারে।
কিছুদিন আগে এক বিচারপতির পূত্রের একটি মামলা হাইকোর্টে আসলে পরপর চারটি বেঞ্চ সেই মামলা শুনতে অপাগরতা প্রকাশ করে এবং সেটির কোনো কারনও পরবর্তিতে আর জানা যায়নি। এখান থেকে ধারনা করা যায় যে একজন সিটিং বিচারপতি [কলিগের পূত্রের] এর পূত্রের মামলা শুনানী করলে সেখানে পক্ষপাতিত্বের আশংকা 'হয়ত' থেকে যায় আর সে কারনেই বিচারপতরা বার বার বিব্রত হয়েছেন।
কিন্তু আমার মনের প্রশ্ন হচ্ছে, এইভাবে সব বিচারপতি-ই যদি একের পর এক বিব্রত হয়, তাহলে কি একজন বিচার প্রার্থী কি বিচার পাবেন না? এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাটা কি?
দুই বছর আগে (৪/৯/২০১৮) আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের মামলার জামিন শুনানীতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ (বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ) বিব্রত বোধ করেন। এসময় জনাব আলমের আইনজীবি ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন বিচারপতিদের কাছে কারন জানতে চান তখন আদালত সারাহ হোসেনকে বলেন 'আপনাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে'
তখন ব্যারিস্টার হোসেন আদালতের কাছে জানতে চান, 'বাস্তবতা কি এটাই যে একজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানো যাবে? সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা তার মুখ থেকে বলা হয়েছে—এটা বলানো হবে? তারপর তাকে আটকে রাখা হবে? তারপর তাকে জামিন চাইতেই দেওয়া হবে না? এটাই কি আমাদের বাস্তবতা?’
এসময় আদালত এই বিব্রত হবার কারন 'কোনো জানানোর বিষয় নয়' বলে শুনানী শুনতে অপাগরতা প্রকাশ করেন। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে জানা গেলো যে শুধু ব্যাক্তিগত সম্পর্ক, পুরোনো ব্যবসদায়িক সম্পর্ক, পুরোনো আইনী সম্পর্কের পরেও 'বাস্তবতা। নামের একটা কারন রয়েছে বিচারপতিদের যেটার কারনেও তাঁরা বিব্রত হতে পারেন।
এই থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বিচারপতির ইচ্ছে হলেই তারা বিব্রত হতে পারেবন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ শুনানী না শুনতে পারেন। এইসব ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের এই প্রচন্ড ক্ষমতাকে আমার স্রেফ বিচার বিভাগীয় গুন্ডামী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না।
একটি জাতির জনকের হত্যাকান্ডের বিচার শুনতে গন্ডায় গন্ডায় বিচারপতিরা বিব্রত বোধ করে কুঁকড়ে একেবারে মিশে গেলেন, শুনলেই মনে হয় ব্যাপারটা এক ধরনের অপরাধের। কোনো জবাবদিহিতা নেই, কোনো ধুরনের ট্রান্সপারেন্সি নেই, কোনো ধরনের ব্যখ্যার দরকার নেই, শুধু একবার বিব্রত হলেই হয়ে গ্যালো।
খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলায় বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকি এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক শুনানীতে বিব্রতবোধ করেন এবং প্রথা ভেঙ্গে তাঁরা সেটির কারনও ব্যখ্যা করেন। তাঁরা জানান এক সময় এই বাড়ীর বরাদ্দ করবার ক্ষেত্রে তাঁরাও জড়িত ছিলেন ফলে তাঁরা এই মামলার শুনানীতে এখন বিব্রত বোধ করছেন।
এই ঘটনার ক্ষেত্রে বলা যায় 'ফেয়ার এনাফ'। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এটি-ই হয়তবা বিব্রত হবার জন্য সঠিক কারন এবং তাঁরা ধন্যবাদের যোগ্য এই কারনে যে তাঁরা কারনটিও যথাযথ ভাবে ব্যখ্যা করেছেন। এইভাবে আমাদের বিচারপতিদের বিব্রত হবার কারনগুলো আমরা এমন প্রতিটি বিব্রত হবার সময়ে জানতে পারলে এট লিস্ট বিচারবিভাগের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাই বাড়বে বৈ কমবে না।
খালেদা জিয়ার বাড়ীর মামলায় যখন বিচারপতি এম আজিজুল হক ও বিচারপতি এ কে এম আবদুল হাকিমের আদালতে যাওয়া হোলো তখন তাঁরাও এই শুনানীতে বিব্রত বোধ করেন কিন্তু আগের দু'জন বিচারপতির মত তাঁরা এর কারন আর বলেন নি বরং বিব্রত হবার কারন রিজার্ভ রেখেছিলেন।
এমন অসংখ্য মামলায় আমাদের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিরা বিব্রত বোধ করেন কিন্তু কারন বলেন না। ফলে আমরা এসব দেখে বিরক্ত ও রাগান্বিত হই। ইনফ্যাক্ট এইসব ট্রান্সপারেন্সির অভাবের কারনে খোদ বিচারপতিরাই তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ 'অস্বাভাবিক' ভাবনার বিকাশ-কেই আসলে আমন্ত্রণ করেন।
যেমন বিব্রত হবার কারন না জানা থাকলে আমরা ভেবে নেই 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় টাকা খাইসে' , 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় সরকারের কথায় উঠ-বস করে', 'ওহ এই বিচারপতি মনে হয় পলিটিকালি ভেতরে ভেতরে ইনভল্বড', ওহ এই বিচারপতি মনে হয় অমুক দল করে-তমুক দল করে'
এইসব ভাবনাগুলো যাতে সাধারণের মধ্যে বিকাশ লাভ না করে, জেঁকে বসতে না পারে, সেটার জন্য আসলে দায়িত্ব বিচারপতিদের-ই নিতে হবে। একজন বিচারপতি বিব্রতবোধ করলে ওপেন কোর্টেই জানিয়ে দিক, 'আমি এই কারনে বিব্রতবোধ করেছি', 'ঐ কারনে করেছি।' ব্যাস ল্যাঠা চুকে যায় এবং আমাদের সন্দেহ-ও আর সেক্ষেত্রে দানা বেঁধে উঠতে পারবে না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন