
শিল্পাচার্যের কবরের পিছনের দেয়ালটা পেরলেই চারুকলা অনুষদ, শিল্পাচার্যের নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিল্পাচার্যের কবরের মলিন দশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং চারুকলা অনুষদের মাঝের অংশটুকু আমাদের সকলের পরিচিত। এখানে আসলেই আমাদের মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের সেই আকুল আবেদন-
"মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।"
হ্যাঁ, এই জায়গাটিতেই আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এখানে আসেন। দিনে পাঁচবার পাশের মসজিদে অসংখ্য মুসল্লীদের পদচারণায় বিদ্রোহী নজরুলের আত্মা শান্তি খুঁজে পায় নিশ্চয়ই! কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা, এখানে আরো কয়েকটি কবর রয়েছে। নজরুলের সমাধির বাম পাশে রয়েছে একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শহীদের কবর। আর ডান পাশে রয়েছে আরো দুটি কবর।

নজরুলের রাজকীয় সমাধির পাশে যাদের সমাধি দুটো নিষ্প্রভ হয়ে আছে, থেকে গেছে আড়ালে। এই সমাধি দুটির একটিতে শুয়ে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং অন্যটিতে পটুয়াশিল্পী কামরুল হাসান। শিল্পাচার্যের কবরের পিছনের দেয়ালটা পেরলেই চারুকলা অনুষদ, শিল্পাচার্যের নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিল্পাচার্যের কবরের মলিন দশা।
নামফলকটিতেও জমে গেছে ময়লার আস্তরণ, নিষ্প্রভ হয়ে গেছে জয়নুল আবেদিনের নামটি। আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে শিল্পীদের সব সময়ই কম মর্যাদা দেয়া হয়, দেয়া হয় কম গুরুত্ব। একজন শিল্পী বা লেখক বা কবি কখনো শিল্প বা সাহিত্যচর্চা করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। তাদের সেই সামাজিক মর্যাদাও দেয়া হয়না। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুলের মতো একজন মানুষ মৃত্যুর পরেও অবহেলিত হচ্ছেন- ব্যাপারটা দুঃখজনক।
শিল্পাচার্যের সৃষ্টিকর্মগুলো মিউজিয়াম-এক্সিবিশনে আলো ছড়াচ্ছে, আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখছি সেগুলো। তাঁর প্রতিষ্ঠান চারুকলা থেকে প্রতি বছর শিল্পজগতে নতুন নতুন নক্ষত্র প্রবেশ করছে। দেশভাগের পর একক চেষ্টায় তিনি দেশে চারুকলার যে বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেটা না হলে আমাদের শৈল্পিক জগত থাকতো অন্ধকার গহ্বরে। এটা জরুরী নয় যে, তাঁর সমাধিতে প্রতিদিন ফুল দিতে হবে কিংবা সেখানে মহা জাঁকজমক করতে হবে।
কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভূমিকা এই দেশে কাজী নজরুল ইসলামের চাইতে কোন অংশে কম নয়। তাই তাঁর সমাধি রক্ষণাবেক্ষণ এবং আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কিংবা মানুষকে তাঁর সমাধি সম্পর্কে জানানো আমাদেরই দায়। সমাধি এলাকার প্রবেশপথে নজরুল সম্পর্কে যেভাবে তথ্য রয়েছে, জয়নুলের সম্পর্কেও সেভাবে থাকতে পারতো, থাকতে পারতো কামরুল হাসান সম্পর্কেও। সেখানে যেমন নজরুল কর্ণার আছে, যেখানে নজরুলের উপর বিভিন্ন বই বা স্যুভেনির পাওয়া যায়, তেমনি সেখানে একইভাবে জয়নুল কর্ণারও থাকতে পারতো। এতে ক্ষতি তো হতো না, উল্টো লাভ হতো ষোল আনা।

জয়নুলের সমাধি আলাদা ভাবে মহিমান্বিত করার কিছু নেই, তিনি তাঁর কর্মের মধ্য দিয়েই টিকে থাকবেন। কিন্তু তাঁর কর্মগুলোকে, তাঁর জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি করে জানানোর চমৎকার একটা সুযোগ হতে পারে- এই সমাধি অঞ্চলে জয়নুলকেও আলাদা গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে। যেন এখানে ঘুরতে এসে, সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে- একজন মানুষ, একটি শিশু তার দেশের অন্যতম সেরা প্রতিভাগুলো সম্পর্কে একসাথে জানতে পারে। সে যেন অনুধাবন করতে পারে- এখানে শুয়ে আছে্ন এই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি, একই সাথে এখানে শুয়ে আছেন এই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন শিল্পীও। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন কি?