২০ বছর রিকশা চালিয়ে যা সঞ্চয় করেছেন, তা বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের সেবায়। এই আলোকিত মানুষগুলো ছিলেন বলেই চারপাশে এতো হতাশার ভিড়ে আমরা দৈব আলোর পরশ পাই। নিজের জীবন অন্যের তরে এভাবে উৎসর্গ করতে পারে কয়জনা?

এক ঝড়ের রাতে হারিয়েছিলেন বাবাকে। সবচেয়ে কাছে হাসপাতালটা ২০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় সেখানে নিতে পারেননি। চোখের সামনে দেখতে বাধ্য হয়েছেন জন্মদাতার চিরতরে চলে যাওয়া। এটা ত্রিশ বছর আগের ঘটনা।

সেই সময় কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে জীবনযাপন করতেন তিনি।  ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তানাশাদিয়া গ্রামে বেড়ে ওঠা এই মানুষটা ঠিক করলেন তার গ্রামের জন্য একটা ক্লিনিক তৈরি করবেন। কিন্তু অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এই মানুষটা সেই সঞ্চয় ছিলো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ঢাকা চলে যাবেন পরিবার নিয়ে। চলেও গেলেন স্বপরিবারে।

শুরু নতুন এক জীবনের পথচলা। এতো বড় শহরে এসে যেন খেই হারিয়ে ফেললেন প্রথমে। প্রথমে ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। শহরের বাইরে থেকে আসা মানুষগুলো, দরিদ্রসীমার নীচে যাদের বসবাস- তারা দিনমুজুরি কিংবা রিক্সা চালোনাটাই পেশা হিসেবে বেছে নেয় শেষমেশ। জয়নালের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

রিকশা চালানো শুরু করলেন তিনি। পুরো শহরজুড়ে যার মাথার ঘাম পায়ে পড়লো। তার স্ত্রী লাল বানু একটা লোকাল ক্লিনিকে কাজ নিলেন। এভাবেই তাদের সংসার চলতো। এরই মাঝে স্ত্রীর কাছ থেকে লুকিয়ে ব্যাংকে একটা সঞ্চয়ী একাউন্ট খুললেন। যেটা দিয়ে নিজ গ্রামে ক্লিনিক তৈরি করার পরিকল্পনা করলেন।

ক্লিনিকের অর্থ যোগাতে গিয়ে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে তাকে। মাঝে মাঝে নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকতো না। স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হতো। তবুও তিনি ক্লিনিকের জন্য জমানো অর্থ খরচ করেননি। এভাবে ২০ বছর রিকশা চালিয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকা সঞ্চয় করেন। এই সঞ্চয় নিয়ে তিনি যখন গ্রামে ফিরলেন, তখন কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চাইলেন না।

এক টুকরো জমি কিনে সেটায় ক্লিনিক বানানোর প্রস্তুতি নিলেন। কোনোমতে একটা অবকাঠামো দাঁড় করালেন। লোকজন এসব দেখে উপহাস করতো, ডাক্তাররা আসতে আসতে চাইতো না। তিনি রিকশাওয়ালা দেখে অনেক তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন। তিনি তার ক্লিনিকের নাম দিলেন মুমতাজ হাসপাতাল।

আস্তে আস্তে তার ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া শুরু হলো। ফ্রী ক্লিনিকের কথা শুনে অনেকে সেখানে আসতে লাগলেন। রোগীর অবস্থা সিরিয়াস হলে তাকে ময়মনসিংহ টাউন হাসপাতালে রেফার করা হতো। প্রতিদিন গড়ে ১০০ মানুষ চিকিৎসা নেয়া শুরু করলো সেখানে।

জয়নাল আবেদিন- দ্য হোপমেকার

একজন লোকাল প্যারাডেমিক এই দায়িত্ব নিলেন। সপ্তাহে একজন ডাক্তার এসে ভিজিট করে যেত। কিছু মানুষও এগিয়ে এলেন সাহায্য করার জন্য। একটা ফ্রী ফার্মেসিও খোলা হয়ে গেলো সেই সাহায্যে। সাধারণ রোগ বালাইয়ের প্রাথমিক চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠলো জয়নাল আবেদিনের গড়া ক্লিনিক।

ছোট্ট একটা ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডও খোলা হলো। মহিলাদের পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো সেখানে। গ্রামের মানুষ যারা প্রথমে হেসেছিলো জয়নাল আবেদিনের কর্মকান্ডে। তারাই গর্বের সাথে তার ক্লিনিকে এসে ফ্রী চিকিৎসা মেডিসিনসেবা নিতে শুরু করলো।

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু ডোনেশন আসা শুরু হলো। সেটা দিয়ে কিছুটা বড় হলো সেই ক্লিনিক। তার পাশেই একটা কোচিং সেন্টার খোলা হলো গ্রামের শিশুদের জন্য। সেখানে ফ্রী পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হলো। প্রায় দেড়শোর মত ছাত্রছাত্রী সেখানে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, গনিত পাঠ নিতে লাগলো।

এটা যদিও খুব বড় মাপের হাসপাতাল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না। তবুও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ যে সেবা পাচ্ছেন এটার মাধ্যমে, সেটা কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন রিকশাচালকের পক্ষে একটা ফ্রী ক্লিনিক এবং কোচিং সেন্টার খোলাটা আসলেই বিশাল ব্যাপার।

আয় উপার্জন বাদ দিয়ে নিজের গড়া স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের সেবায় নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছেন। সারা জীবনের সঞ্চয় মানুষের তরে উৎসর্গ করার মত এই মানুষগুলো ছিলেন বলেই চারপাশে এতো হতাশার ভিড়ে আমরা দৈব আলোর পরশ পাই। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো আপনার প্রতি, একজন আলোকিত মানুষ জয়নাল আবেদিন- দ্য হোপমেকার!  

তথ্যসূত্র- বিবিস, ডেইলি স্টার 

আরো পড়ুন- 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা