কার্টুন আঁকার জন্যে জেলে যেতে হবে, ট্রল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হতে হবে, সংবাদ প্রকাশ করে অপহরণ আর নির্যাতনের শিকার হতে হবে- এই রাষ্ট্রে কি কারো কথা বলার অধিকার থাকবে না?

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার নিখোঁজ হয়েছিলেন চারদিন আগে। থানায় জিডি করা হয়েছিল, গতকাল তাকে উদ্ধার করা হয়েছে কুমিরা এলাকার একটি খালের পাশ থেকে। পুলিশ নয়, স্থানীয় লোকজনই খুঁজে পেয়েছে। গোলাম সরোয়ারকে যখন উদ্ধার করা হচ্ছিল, তখন তিনি একটা কথাই বলছিলেন বারবার- ‘ভাই, আমারে মাইরেন না। আমি আর নিউজ করব না।’ আমাদের এই রাষ্ট্রটা একজন সাংবাদিকের জন্য কতটা অনিরাপদ, কত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় পরিণত হয়েছে, সেটা গোলাম সরোয়ারের ওই এক লাইনের বাক্যটাতেই পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। 

গোলাম সরোয়ার ‘আজকের সূর্যোদয়ের’ স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটি নিউজ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক৷ গত ২৯ অক্টোবর তাকে চট্টগ্রামের ব্যাটারি গলি থেকে অপরহরণ করা হয়৷ এখন তিনি চিকিৎসাধীন আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার সঙ্গে সাংবাদিকেরা কথা বলতে পারেননি, তবে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) এর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেছেন, ‘‘গোলাম সরোয়ারকে অপহরণ করা হয়েছিলো পেশাগত কারণেই৷ তিনি নিউজের কারণেই অপহৃত হয়েছেন৷’’

সিটি নিউজ পোর্টালে গত ২৩শে অক্টোবর একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, জমি দখল নিয়ে ছিল সেই প্রতিবেদনটি। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি সরকারি জমি দখল করেছেন৷ ধারণা করা হচ্ছে, সেই প্রতিবেদনের কারনেই অপহৃত হতে হয়েছে গোলাম সরোয়ারকে। অপহরণের পর তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। সেই নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে, উদ্ধার হবার পরেও তিনি প্রলাপ বকছিলেন আর কখনও নিউজ করবেন না বলে! 

উদ্ধারের পর গোলাম সরোয়ার সংবাদ মাধ্যমকে সংক্ষেপে তার ওপর নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন৷ অপহরণকারীরা বার বার যখন অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল তখন অপর প্রান্তের ব্যাক্তিটকে তারা স্যার স্যার বলে সম্বোধন করছিলো৷ তারা আরও বলছিল, ‘‘সাংবাদিকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরোয়ারকে তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়৷’’ তারা তাকে নির্যাতনের সময় বার বার বলছিল, "আর নিউজ করবি?" 

সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার, উদ্ধারের পর

প্রভাবশালী কারো নির্দেশেই যে গোলাম সরোয়ারকে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। দিনে দুপুরে একজন সাংবাদিককে অপহরণ করা হলো, তিনদিন ধরে তিনি নিখোঁজ রইলেন, পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে পারলো না। রাষ্ট্র তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারছে না, অপহৃত নাগরিককে উদ্ধার করতে পারছে না, অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করতে পারছে না- রাষ্ট্রের ব্যর্থ এই চেহারাটা কি আমাদের চোখে পড়ছে? 

ডয়েচে ভেলেতে প্রকাশিত সিংবাদ অনুযায়ী- আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে এই বছরেরই জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ২০৯ জন সাংবাদিক হুমকি, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ১৯ জন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে এবং ৩৫ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন৷ খবর প্রকাশের জন্য ৮১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরপত্তা আইনসহ অন্য আইনে মামলা হয়েছে৷ হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ২৩ জনকে৷ নিহত হয়েছেন একজন সাংবাদিক৷ 

এবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ৬৩ জনের বিরুদ্ধে এবং ২০১৮ সালে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই দশ মাসে ৩৮ জন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে৷

এদেশে ক্ষমতাবানদের পাপাচারের কথা প্রকাশ করলে গোলাম সরোয়ারের মতো অপহৃত হতে হয়। সাংসদকে নিয়ে প্রকাশিত খবর ফেসবুকে শেয়ার দিলে সাংবাদিক কাজলের মতো ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকতে হয়, তারপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জেলের ঘানি টানতে হয়, বারবার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় আদালতে। যুদ্ধাপরাধীরাও যেখানে মাসের পর মাস হাসপাতালে কাটানোর সুযোগ পান, সেখানে অসুস্থ কাজলদের জায়গা হয় কেরাণীগঞ্জের কারাগারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়টা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হলে সমস্যা নেই, সেই দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে কার্টুন এঁকে জেলে যেতে হয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরকে। এরপরও যদি কেউ বলে যে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি আছে, সৎ এবং নির্ভীক সৎবাদিকতার জায়গা আছে, আমি অন্তত তার সঙ্গে একমত হবো না কোনভাবেই।

গত কয়েকদিন ধরে গণহারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের বহিস্কারের খবর আসছে, অভিযোগ একটাই- ধর্ম অবমাননা না কটুক্তি। কেউ ফ্রান্স বয়কট নিয়ে ট্রল করলে তাকেও কটুক্তির কারনে বহিস্কার করা হচ্ছে! এসবের মানে কি? কার্টুন আঁকার জন্যে জেলে যেতে হবে, ট্রল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হতে হবে, সংবাদ প্রকাশ করে অপহরণ আর নির্যাতনের শিকার হতে হবে- এই রাষ্ট্রে কি কারো কথা বলার অধিকার থাকবে না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপারটাকে কৌতুকে পরিণত করার মানে কী? বঙ্গবন্ধু বিরুদ্ধ মতের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন- কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধেও কথা বলে, আর সেটা যদি যুক্তিপূর্ণ কথা হয়, আমরা তা শুনব। 'বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা' বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে আমরা কি দেশটাকে মগের মুল্লুক বানিয়ে ফেলছি না? 

ছবি কৃতজ্ঞতা- হুমাউন মাসুদ, ডয়েচে ভেলে

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা