বাংলাদেশে এই বয়সের একটা ছেলে জেএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পাবার জন্যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ আর সেই চৌদ্দ বছর বয়সে জোসে কিনা আস্ত একটা ব্যাংকের মালিক হয়ে বসেছে!

১৪ বছর বয়সে আপনি সর্বোচ্চ কী করেছেন বলার মতো? একটু স্মরণ করার চেষ্টা করে দেখুন। খুব বেশি কিছু আছে কি? কিন্তু এই বয়সেই একটা ছেলে যদি আস্ত একটা ব্যাংকের মালিক হয়, বিশ্বাস হবে? বাংলাদেশে এই বয়সে তো বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার কথাও চিন্তা করে না। ডেবিট, ক্রেডিট বুঝার বয়সও না এটা। কিন্তু এই বয়সেরই একটা ছেলে খুলে ফেললো একটা গোটা ব্যাংক। 

ছেলেটির পেরু নামক দেশের নাগরিক। বয়স যখন সাত, তখন সে এই ব্যাংকটি চালু করে। তার নাম হোসে। সে খেয়াল করে দেখে, তার সকল বন্ধুরাই প্রচুর টাকা ওড়ায়। কিন্তু, টাকা জমায় না। অকাতরে উড়ালে সাত রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। হোসে এই বয়সেই কীভাবে যেন বুঝে, অর্থ সম্পদ শুধু খরচ করা উচিত নয়, জমানোও উচিত। কারণ, অর্থ খরচ করা যত সহজ, উপার্জন ততটা নয়। তাই অর্থ উপার্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই হোসে চিন্তা নেয়, সে একটি ব্যাংক চালু করবে। 

কিন্তু, গতানুগতিক ব্যাংকের চেয়ে হোসের আইডিয়া ছিল ভিন্ন। তার চিন্তা ছিল, কীভাবে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা অর্থ জেনারেট করতে পারে তাদের বাবা-মায়ের সাহায্য ছাড়াই। অনেক ভেবে সে দেখলো, রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে এটি সম্ভব। কীভাবে?

বর্তমান বিশ্বে ভয়াবহ একটি গ্লোবাল সমস্যা হলো, পরিবেশ দূষণ। মানুষই পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছে ময়লা ফেলে। বর্জ্য তৈরি করে। তাই হোসের ব্যাংকিং আইডিয়াটি দাঁড়াল এমন, এখানে একাউন্ট খুলতে হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ বর্জ্য জমা দিতে হবে। এবং প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ বর্জ্য ডিপোজিট হিসেবে দেয়ার প্রতিজ্ঞা দিতে হবে। এই বর্জ্যগুলোকে হোসে স্থানীয় এক কোম্পানি দ্বারা রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী পন্য হিসেবে তৈরি করবে। এই প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ হবে ব্যাংকটির গ্রাহকদের একাউন্টে। এই অর্থ তখনই তোলা যাবে যখন গ্রাহক তার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পরিমাণ বর্জ্য জমা দিবে। এই অর্থ গ্রাহকই উত্তোলন করতে পারবে। এর জন্য তার বাবা মা, চৌদ্দগোষ্টীর অন্য কারো এপ্রোভাল লাগবে না। লাগবে না কোনো ভং চং সত্যায়িত কপি। 

হোসের বয়স যখন সাত, তখন সে প্রথম এ আইডিয়া নিয়ে কাজ করার কথা ভাবে

অসাধারণ এই আইডিয়ায় অল্পবয়সীদের অর্থ উপার্জনের একটা পথ তৈরি তো হয়েছেই, তার চেয়ে বেশি করে যা হয়েছে তা হলো পরিবেশ সচেতনতা। প্রকৃতিকে ভালবাসার শিক্ষা।

হোসে প্রথম এই আইডিয়া নিয়ে কাজ করার কথা ভাবে সাত বছর বয়সে। যখন অনেকে ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ঠিকমতো প্যান্টও পরতে শিখেনি অনেকে সেই বয়সে এই ছেলে এই আইডিয়া শুনায় তার স্কুলে। অনেকেই অবাক হয় এবং কেউ কেউ আছে যারা হাসাহাসিও করে। যেটা প্রায় প্রত্যেক সমাজেই আছে যে, বয়সে ছোট মানে তার মতামত নেয়া যাবে না, কম বয়সে কিছু করা মানেই সেটাকে পাকনামি ভাবা - এই মানসিকতার শিকার হয়েছে হোসেও। 

তবে, সে হাল ছাড়েনি। কারণ, তার মনের মধ্যে গেঁথে যায় স্বপ্নটি। সে একটা পিচিংয়ে এই কথাও বলে যে, "অনেকেই বলে শিশুরা ভবিষ্যৎ, কিন্তু তারা এটাও দেখতে পায় না শিশুরা ভবিষ্যৎ নয়, শিশুরাই বর্তমান।" বর্তমানকে অস্বীকার করে যারা শিশুদের, তরুণদের ভাল কাজকে উপেক্ষা করে তাদের জন্যেও একটা বড় শিক্ষা হোসের এই ব্যাংক। 

হোসের এই অদ্ভুত সুন্দর ব্যাংকটির নাম "বার্টসেলেনা চিলড্রেন ব্যাংক"। তার এই আইডিয়া অল্পদিনে বেশ আলোচিত হয়। পেরুর এক মেইনস্ট্রিম ব্যাংক হোসেকে অফারও দেয়, একসাথে কাজ করার। কিন্তু, হোসে স্পষ্টভাবেই বলে, সে এই প্রজেক্টকে একাই সামলাতে পারবে। আদতেই তাই। এখানে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করে হোসের এই ব্যাংকে। এবং সবাই বয়সে তার বড়। সে সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু সে এই বয়সেই অসাধারণ দূরদর্শী। বেশ অনেকগুলো এওয়ার্ড পেয়েছে ইতিমধ্যে। জলবায়ু এবং উদ্যোক্তা বিষয়ক এইসব পুরষ্কার তার এই ব্যাংকের চলার পথে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে নিশ্চয়ই। 

তবে, সবচেয়ে বড় অর্জন তো আসলে সাহস এবং পৃথিবীতে নিজের পদচিহ্ন রেখে যাওয়ার এই চেষ্টা। যা অনেকের মধ্যেই নেই। হোসের ব্যাংকটির জন্য শুভকামনা, সেই সাথে বাংলাদেশের অভিভাবকদের প্রতিও শুভকামনা। শিশুরা ভিন্ন কিছু চেষ্টা করলে সেটা প্রতিহত করুন, তাকে এক হালি কোচিংয়ে ভর্তি করান, স্কুল ব্যাগটাকে বইয়ের বোঝা বানিয়ে দিন এবং সবশেষে জেএসসির এ+ এর মিষ্টি বিতরণ করে সন্তুষ্ট থাকুন, এটাই ভাল...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা