হোসে মুজিকা: বিশ্বের সবচেয়ে গরীব রাষ্ট্রপতি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আচ্ছা আপনাকে যদি বলি, যেকোনো একটা দেশের রাষ্ট্রপতিকে মনে মনে কল্পনা করতে, তাহলে আপনি কেমন কল্পনা করবেন? হাই সিকিউরিটি, প্রচুর পাওয়ার, গ্ল্যামারে ভরপুর, অনেক বিত্তশালী... এরকমই, তাই তো? উনিশ-বিশ হতে পারে, কিন্তু এই ফ্রেমের বাইরে সাধারণত আমাদের কল্পনা যাবে না। কিন্তু কেমন হয় যদি সেই রাষ্ট্রপ্রধানটি আমাদের চেয়েও দীনহীন হন?
হ্যাঁ, আজকে যেই মানুষটিকে নিয়ে কথাবার্তা তিনি আমাদের দীনহীন রাষ্ট্রপ্রধান হোসে আলবার্তো 'পেপে' মুজিকা কর্ডানো। যাকে আখ্যায়িত করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে গরিব রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তাঁর বৈচিত্র্যময় সাদামাটা জীবনের গল্পই শুনবো আজ।
হোসে মুজিকার জীবন আসলে মাল্টিলেয়ার কমার্শিয়াল সিনেমার চেয়েও মারাত্মক। কী নেই সেই জীবনে? দারিদ্র্য, রাজনীতি, বিদ্রোহ, ব্যাংক লুট, খুন, কারাবরণ, ক্ষমতা... বলিউডের বক্স অফিস হিট সিনেমাগুলোর মতন সব এলিমেন্ট আছে এখানে।
মাত্র ৮ বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে মুদ্রার ওপাশটা দেখা হয়ে যায় মুজিকা'র। সেই বয়স থেকেই বেকারির ডেলিভারি বয়, হোটেল বয়, ফুলের দোকানদার হয়ে সংগ্রাম করতে থাকেন জীবনের সাথে৷ যাদের খুব ছোট বয়সেই জীবনের উল্টোপিঠটি দেখতে হয়, তাদের হৃৎপিণ্ডটি বেশ শক্তপোক্ত হয়ে বেড়ে ওঠে। মুজিকারও সেরকম। শক্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে আস্তে আস্তে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বামধারার রাজনীতি নিয়ে। বাম চরমপন্থী নেতা হিসেবে বেশ ত্রাস তৈরী করেন উরুগুয়েতে। সবাই এক নামে চিনতো তাকে।
তৎকালীন সময়ে উরুগুয়ের বেশ জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা ছিলেন এনরিকে এরো। তাঁর সংস্পর্শে এসে মুজিকা আরো প্রভাবশালী হতে থাকেন। সে সাথে আরো ত্রাসের রাজত্বও কায়েম হতে থাকে। কিন্তু বেশিদিন চলেনা তা। বাঙ্গালীদের খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব চে গুয়েভারার সংস্পর্শে এসে পাল্টে যায় মানসিকতা, সে সাথে জীবনের অর্থও। উরুগুয়ের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা তখন চরমে। সেই সময়ে চে'র সাথে একত্রিত হয়ে মুজিকা ও তার দলবল শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করেন। তৈরী হয় গেরিলা বাহিনী টুপামারো।
"টুপামারো" নাম এসেছে পেরুর কিংবদন্তী বিপ্লবী টুপাক আমারুর নামানুসারে। এই টুপামারো গেরিলা স্টাইলে বিত্তশালীদের আক্রমণ করতো, ব্যাংক লুট করতো এরপর এই অর্থগুলো দরিদ্র, মেহনতী, দুঃখী মানুষের জন্য ব্যয় করতো। খুন, জখম করতেও পেছপা হননি তারা। তাদের এই কর্মকাণ্ডে টাইমস ম্যাগাজিন তাদের নিয়ে নিউজও করে- 'রবিন হুড গেরিলা' নামে।
তবে টুপামারো বেশিদিন চলেনি। দলের মধ্যে কোন্দল, নিরীহ মানুষদেরও টাকার জন্যে খুন করা সহ বিভিন্ন কারণে গেরিলা সংগঠনটি নিয়মিত ব্যাকফুটে যেতে থাকে। পুলিশের সাথে একবার ধ্বস্তাধস্তি হলে পুলিশ মুজিকা সহ কয়েকজন টুপামারোকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। যদিও জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি দুইবার। কিন্তু বিধিবাম! দুইবারই ধরা পড়েন তিনি। এরপর শাস্তি হিসেবে মুজিকাকে সলিটারি সেলে কাটাতে হয় অনেকটা দিন।
প্রায় চৌদ্দ বছর জেলের জীবনযাপন শেষে ১৯৮৫ সালে তিনি মুক্তি পান। মুজিকা ভাবলেন, অনেক হয়েছে এ্যাডভেঞ্চার! এবার জীবনে একটু থিতু হতে হবে। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ আগে থেকেই ছিলো। আবার শুরু করলেন রাজনীতি। অল্প সময়েই বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। বামপন্থী ব্রড ফ্রন্টের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ব্রড ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। সে বছরেই আবার তিনি বিয়ে করেন দীর্ঘ ২০ বছর ধরে প্রেম করে আসা প্রেমিকা লুসিয়া টোপোল্যোনস্কি'কে। ২০০৫-০৮ সালের সময়কালে মুজিকা পশুসম্পদ, কৃষি ও মৎসমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি সিনেটরের দায়িত্বও পালন করেন। ব্রড ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে তিনি জেতেন এবং ১ মার্চ ২০১০ সালে আসেন উরুগুয়ে শাসন করার জন্যে।
ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন বলেই কী না জানা নেই, তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও খুব একটা পোশাকি ব্যাপারস্যাপার গা করতেন না। সাদাসিধে জামাকাপড় পরে ঘুরতেন এবং মানুষকে বিস্তর গালিগালাজ করতেন। খিটখটে মেজাজী ছিলেন তিনি। মানুষজনেরও তাকে নিয়ে দুরকম ধারণা ছিলো। একদল ভাবতেন, তিনি খিটখিটে হলেও বিপ্লবী, ভালো মানুষ, ত্যাগী নেতা। আরেকদল ভাবতেন, এগুলো সবই মুজিকার অভিনয়। সে আসলে ভণ্ড, অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই না।
তবে যেটাই হোক বিশ্বের সবচেয়ে গরিব রাষ্ট্রনায়ক থোড়াই কেয়ার করতেন সবকিছুকেই। এবং বেশ পাগলাটেও তিনি। উরুগুয়েতে গাঁজার চাষ ও গাঁজার ব্যবসা করাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন তিনি। তাছাড়া সমকামী বিবাহ ও গর্ভপাতেও আইনি অনুমোদন দিয়ে রেখেছেন। সহজ সরল জীবনযাপন আর গালিগালাজে ভরা কথাবার্তার এই মানুষটিকে উরুগুয়ের অধিকাংশ মানুষই বেশ ভালোবাসে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রাপ্ত বেতনের ৯০ ভাগই তিনি গরিবদের জন্যে, ছোট ছোট বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দেশের সামাজিক সেবামূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে দান করেন নিয়মিত। কে জানে, হয়তো ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামে বড় হয়েছেন বলেই বেশি বিলাস ধাতে সয়না তার। এবং নিজের এরকম সাদামাটা জীবনযাপন নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে নিজেই নিষ্পৃহবাক্যে বলেন-
আমার যা আছে, আমি তাতেই খুশি।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন