জন নার: রাজনীতিবিদদের ওপর বিরক্ত হয়ে যে কমেডিয়ানকে মেয়র বানিয়েছিল আইসল্যান্ডের মানুষ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

মজা করেই 'দ্য বেস্ট পার্টি' নামের দলটা গড়েছিলেন। ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেও গেলেন জন নার, স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান থেকে হয়ে গেলে পলিটিশিয়ান, হয়ে গেলেন আইসল্যান্ডের রাজধানীর 'অ্যাক্সিডেন্টাল' মেয়র! অথচ চার বছর পর তিনি নিজেই রাজনীতি থেকে পালাতে চাইছেন!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ইচ্ছাপূরণ' গল্পের কথা মনে আছে? যদি মনে না থাকে, তাহলে একটু মনে করিয়ে দেই। সুবলচন্দ্র ও তার ছেলে সুশীলচন্দ্র, দুইজনেরই ছিলো অদ্ভুত ইচ্ছে। বাবা যেতে চাইতেন ছেলের বয়সে, ছেলে আবার বাবার বয়সে। একদিন 'ইচ্ছাদেবী' এসে পূরণ করে দিলেন তাদের ইচ্ছা। বিপত্তি ঘটলো তার পরেই। কী বিপত্তি, তা আর না বলি বরং। যারা আগে পড়েছিলেন গল্পটা, নিশ্চয়ই মনে পড়েছে। আর যারা এখনো পড়েননি, পারলে আজকেই পড়ে নেবেন গল্পটা। আজকে যে ঘটনা বলতে যাচ্ছি, তার সাথে 'ইচ্ছাপূরণ' গল্পের আছে তীব্র মিল। আমাদের আজকের ঘটনার মূল চরিত্র জন, যিনি একজন স্টান্ডাপ কমেডিয়ান। পাকেচক্রে যিনি হয়ে যান আইসল্যাণ্ডের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর রেইকিয়াভিক এর মেয়র। কিভাবে? সে গল্প শুনলে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে স্বাভাবিক যে কারোরই।
প্রথমে জনের একটু পরিচয় দেয়া দরকার। আইসল্যান্ডে জন্ম নেয়া এই কমেডিয়ানের প্রথম জীবনটা মোটেও সুখকর ছিলো না। মা ছিলেন প্রচণ্ড মাত্রায় অ্যালকোহলিক। বাবাও ছিলেন মানসিকভাবে বিক্ষুব্ধ। এরকম অস্বাভাবিক বাবা-মা'র সাথে টালমাটাল পরিবারে জনের জীবন কিভাবে কেটেছে, সেটা সহজেই অনুমেয়। খুব অল্পবয়সে স্কুলে থাকতেই জন 'স্ট্যান্ডাপ কমেডি' করা শুরু করে। এই কমেডির জন্যেও মাঝেমধ্যে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হতো। যার জীবনে ছোটবেলা থেকেই এত সমস্যা, সেই জন চাইতো- কমেডি করে যদি দুঃখ থেকে একটু সরে থাকা যায়, সেটাও বা খারাপ কি! তার কমেডিতে আসার মূল প্রেরণা এটাই।
তবে স্কুলে কমেডির দৌরাত্ম বেশিদিন চালানো সম্ভব হয় না। জনের মা জনকে রেখে আসেন আইসল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের দুর্গম এক স্কুলে। তখন জনের বয়স মাত্র চৌদ্দ। এই পাণ্ডববর্জিত স্থানে কাটাতে হয় বেশ কিছু বছর। সেখানে বলতে গেলে একরকম জেলখানার মধ্যেই জীবন এগোচ্ছিলো। চার্লি চ্যাপলিনের জীবনী থেকে যেমন আমরা জানি, প্রবল দারিদ্র্য ও দুঃখ থেকেই তাঁর কমেডিতে আসা, রবিন উইলিয়ামসের বই থেকেও জানি- জীবনভর প্রচুর ধাক্কা খেয়েছেন আর স্টেজে এসে সেগুলোকে 'কমেডি' বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন মানুষের হাসির স্রোতের মাঝখানে... একই ঘটনা দেখি আমরা জনের ক্ষেত্রেও৷ জীবনব্যাপী বিভিন্ন, বিচিত্র ধাক্কা তাকে আস্তে আস্তে পরিণত করে কমেডিয়ানে।
জন এভাবেই চালাচ্ছিলেন তার কমেডি। তবে এরইমাঝে আইসল্যান্ডে কিছু সংকট দেখা যায়। তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়। সবাই সবার মতন প্রতিবাদ করছিলেন এই অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে দায়ী প্রশাসনের বিপক্ষে। জন ভাবলেন, তারও প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু জন কিভাবে প্রতিবাদ করবেন? তিনি না পারেন লিখতে, না পারেন গাইতে, না পারেন সমাবেশ তাতিয়ে তোলা বক্তৃতা দিতে৷ কী করা যায়! তিনি তার প্রথাগত অস্ত্র 'কমেডি' দিয়েই প্রতিবাদ করবেন, শেষমেশ এটাই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
খুলে ফেললেন একটি দল, দলের নাম 'The Best Party', অবশ্য বিভিন্ন টিভি শো'তে তিনি এই পার্টির নাম আগেও বলেছিলেন। এবং বলা হলো, এটা কোনো রাজনৈতিক দল না বরং গণতান্ত্রিকভাবে সবাইকে সাহায্য করার একটি সংস্থা। এবং এই পার্টির মূলকথা- সততা, সহমর্মিতা, অহিংস আচরণ এবং অবশ্যই-মজা। 'দ্য বেস্ট পার্টি'র লোগোটাও অদ্ভুত; অনেকটা ফেসবুকের 'লাইক' চিহ্নের মতন। জনের ভাষাতেই-
আমরা এই লোগোতে সবচেয়ে বাজে কালার কম্বিনেশন ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট ডিজাইন ব্যবহার করেছিলাম। যাতে করে এটা দেখতে ভালো না লাগে।
নির্বাচিত হলে আইসল্যান্ডের 'সুইমিংপুল'গুলোতে টাওয়েল দেবেন, পোলার বিয়ার আনবেন এবং একটি ডিজনিল্যান্ড বানাবেন... এরকম ঘোষণাও জন দিয়ে রাখেন তার ক্যাম্পেইনে। মানুষজনও তার ক্যাম্পেইনগুলোতে বেশ হাসাহাসি করতো। কেউই খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি এই প্রতিশ্রুতিগুলোকে৷
কিন্তু যখন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়, দেখা যায়, তিনিই আইসল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে শহর ও রাজধানী রেইকিয়াভিক এর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। যেদিন তিনি মেয়র নির্বাচিত হলেন, সেদিন নিজের মনেই তিনি বারবার বলছিলেন-
আমার সাথেই কেন বারবার এই কমেডিগুলো হয়!
তবু কথাতেই তো আছে- 'পড়েছি মুঘলের হাতে। খানা খেতে হবে সাথে।' জনগন ভালোবেসে একটা দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা তো পালন করতেই হবে। জন, মেয়রের দায়িত্বে মনোযোগ দিলেন। এবং চার বছরে খুব একটা খারাপও করেননি৷ পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, সমাজ সংস্কার বিষয়ক নানা বিষয়েও কাজ করেছেন৷ সেসবের ডিটেইলসে যাচ্ছি না। তবে চার বছর পরে তিনি যখন দায়িত্বপালন শেষে বের হলেন, তিনি বললেন-তিনি আর রাজনীতি করতে চান না। তিনি আবার ফিরে যেতে চান তার প্রিয় জগতে, কমেডি'র জগতে৷

জনের এই ঘটনাটি ভাবিয়েছে নানা দিক থেকে। আইসল্যান্ড, বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাজনৈতিক কাঠামোর এক দেশ৷ সে দেশের মানুষজনই যদি রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে এত হতাশ থাকে, তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কী করা উচিত আমাদের, সেটা গবেষণার বিষয়। সে দেশের জনগন এতটাই বিরক্ত শাসকদের উপরে, তাদেরকে উচ্ছেদ করে একজন 'কমেডিয়ান'কে নির্বাচিত করতেও তারা দু'বার ভাবেন নি। সবার যাপিত ক্ষোভ, ক্রোধ, হতাশা তারা উগরে দিয়েছেন ভোটবাক্সে। এভাবেই নির্বাচিত হয়েছেন জন। এতটাই প্রাধান্য পায় সেখানে জনতার মতামত। এতটাই শক্তিশালী তারা!
চার বছর ধরে মেয়রের দায়িত্ব পালন করে এসে জনেরও হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের হাসিখুশি চেহারা এখন আর নেই। বুঝেছেন, রাজনীতিতে ম্যানিপুলেশনই সব, আইডিয়াল এর এখানে কোনো জায়গা নেই।বুঝতে পেরেছেন, এখানে ভালো নেতা হতে গেলে আদর্শ থাকা লাগে, এরকম না। মানুষকে হাতে রাখতে হয়। যে যত বেশি মানুষকে হাতে রাখতে পারে, সে তত ভালো নেতা। জন হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসেন, সরলরৈখিক চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসেন। তিনি এত জটিলতা পছন্দ করবেন না, তা বলাই বাহুল্য। এ কারণেই রাজনীতির তল্লাটও আর মাড়াতে চান না তিনি।
আইসল্যান্ডের মানুষজনের কথা ভাবি আর ঈর্ষান্বিত হই। সেখানে নেতা পছন্দ না হলে মানুষজন ভোট দিয়ে নেতাকেই পরিবর্তন করতে পারেন। অথচ, আমার দেশে? নেতা পরিবর্তন তো রূপকথা, ভোট দেয়ার অধিকার আছে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন