চার দশকের লড়াই, হার না মানার জেদ ও হোয়াইট হাউজের টিকেট!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

আমরা সফলতার গল্পগুলো মনে রাখি, ব্যর্থতার গল্পগুলোকে এড়িয়ে যাই। এই গল্পটা জো বাইডেনের ব্যর্থতার গল্প। পেনিসেলভানিয়ার তোতলা ছেলেটার গল্প, লেখা চুরির দায়ে অভিযুক্ত এক নেতার গল্প, স্ত্রী-সন্তানকে হারানো একজন মানুষের গল্প, গতকাল যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন...
একজন মানুষ আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন গত চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যে স্বপ্ন তিনি দেখে এসেছেন এতদিন ধরে, হোয়াইট হাউসের অধিবাসী হবার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে গত রাতেই। সাতাত্তর বছর বয়সে যখন মানুষ সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয় নিজেকে, সে সময়েও তিনি বজায় রেখেছিলেন অদম্য ইচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি, আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত প্রেসিডেন্টকে অপসারন করে হোয়াইটে হাউসের টিকেটও পেয়ে গিয়েছেন বাইডেন। ছোটবেলার অভাব অনটন, নিজের শারীরিক সমস্যা, পারিবারিক ট্রাজেডি, ধাক্কা খাওয়া, আবার উঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ বজায় রাখা, শেষে এসে সেই যুদ্ধ জয়ী হওয়া- জো বাইডেন নিজেকে প্রমাণ করেছেন বড় ক্যানভাসের অদ্ভুত সফল এক গল্প হিসেবেই।
ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে একটা কথা বরাবরই বলা হয়; রূপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছে। বাইডেনের ক্ষেত্রে এই কথাটি আরেকটু বাড়িয়ে বলতে হবে- রূপোর চামচ মুখে দিয়ে বাইডেন জন্মালেও রূপোর চামচটা জন্মের খানিক পরেই কেড়ে নেয়া হয় তার মুখ থেকে। কেন তা বলছি, সেটার উত্তর দিচ্ছি। বাইডেনের বাবা ছিলেন বড়সড় এক ব্যবসায়ী। ঘরে অর্থবিত্তের অভাব ছিলোনা মোটেও। কিন্তু বাইডেনের জন্মের পরেই বাবার ব্যবসায় ধ্বস নামতে থাকে। যাদের পরিবারে ছিলো অঢেল ধনসম্পদ, তারাই ক্রমশ হতদরিদ্র হতে থাকেন। বোধবুদ্ধি হবার পর থেকেই তাই দারিদ্র্য দেখে বড় হয়ে উঠেছে বাইডেন। পেনসিলভেনিয়ায় আটপৌরে হতদরিদ্র যৌথ পরিবারে এভাবেই কায়ক্লেশে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা বাইডেনের।
দারিদ্র্যের মধ্যেও একসময়ে ভর্তি হলেন স্কুলে। সেখানে আরেক বিড়ম্বনা। ছোটবেলা থেকেই তোতলামির সমস্যা ছিলো তার। তোতলামির কারণে স্কুলের সবাই বেশ খ্যাপাতো। যদিও পরবর্তীতে এই সমস্যা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু যে ক'দিন এই সমস্যা ছিলো, স্কুলের ছেলেমেয়ে, এমনকী শিক্ষকেরাও বাইডেনকে নিয়ে নিয়মিত মুখরোচক হাসিঠাট্টা করতেন। এই হাসিঠাট্টার বিষয়টি ছোট্ট বাইডেনকে ভেতরে ভেতরে আরো সংকুচিত করে দিতো। লজ্জা, রাগ, কষ্টের মিশ্র শরবত গিলে বাইডেন তখনই বুঝেছিলো, পৃথিবীটা এমনই।
তবে তোতলামি কীভাবে দূর করা যায়, সে বিষয়কে তিনি নিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে তোতলামি কাটিয়ে কথা বলার অভ্যাস আয়ত্ত করা শুরু করেন তিনি। এভাবেই নিয়মিত প্রাকটিসে হাইস্কুলে উঠতে উঠতে তোতলামো কেটে যায় তার। হাই স্কুল শেষ করে তিনি পড়তে যান ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে আইন পড়তে যান সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে দেখা হয় নেইলিয়া হান্টারের সাথে। যিনি পরবর্তীতে হয়ে যান বাইডেনের জীবনসঙ্গী।
কলেজ শেষ করে বাইডেন উইলমিংটনে থিতু হন। আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু হয় তার। কিন্তু ফরমায়েশি কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছিলেন তিনি এখানে। আইন ছেড়ে তাই মনোযোগী হন রাজনীতিতে। উইলমিংটন নগর পরিষদের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন ঝোঁকের মুখে। অদ্ভুত বিষয়, তিনি জিতেও যান। শুরু হয় রাজনীতিতে তার পথচলা।
এরপর সিনেট নির্বাচনে জেতেন তিনি। তখন তার বয়স মাত্র ত্রিশ! মাত্র ৩০ বছর বয়সেই তিনি দুই মেয়াদে সিনেটার থাকা রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে এক চমক দেখান সবাইকে। হয়ে যান আমেরিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর! এই বিষয়টা বলা যায় তার জীবনেরই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায়। বাইডেন তখন রাজনীতিতে বেশ পরিচিত মুখ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জো বাইডেনের পরিচয় তখন একটাই 'রাইজিং স্টার।'

এরমধ্যেই তার জীবনে আসে বড়সড় ধাক্কা। ক্রিসমাস সামনে। ঘরের জন্যে ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়েছিলেন বাইডেনের স্ত্রী ও তিন সন্তান। বাইডেন তখন সবে সিনেটার নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে তিনি ব্যস্ত। তিনি ছাড়া সবাই তাই গিয়েছে শপিং করতে। এমন সময় জানা যায় লরির সাথে গাড়ির ধাক্কায় তার স্ত্রী নেইলিয়া ও শিশুসন্তান নেওমি মারা গিয়েছে। দুই ছেলে বেঁচে আছে, কিন্তু বেশ আহত তারা। এই খবরে পায়ের নিচের মাটি দুলে ওঠে বাইডেনের।

বড়সড় এই শোক কাটাতে তার অনেক সময় লেগেছিলো। অনেকটা সময় তিনি হতাশা ও মানসিক বিষাদের মধ্যে ছিলেন। রাজনীতিও ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু আগেই বলেছি, বাইডেন এত সহজে হার মানেন না। সময় নিলেন, কিন্তু তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। ১৯৮৭ সালের দিকে এসে জো বাইডেন ভাবলেন, তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হয়ে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ক্যাম্পেইন চলছে, তখন আসে আরেক দুঃসংবাদ। বাইডেনের বিরুদ্ধে অন্যের লেখা চুরির ও অসততার অভিযোগ আনা হয়। লজ্জাজনক এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেন নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়াতেও বাধ্য হন শেষমেশ। জানা যায়, আইওয়ার কোনো একটি সমাবেশে তিনি বক্তৃতা দেয়ার সময়ে ব্রিটিশ লেবার পার্টির এক নেতার বক্তৃতা হুবহু আওড়ে গিয়েছিলেন এ বিষয়টা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা হয়। জানা যায় আরো তথ্য। বাইডেন ছাত্র থাকা অবস্থাতেও অন্যের থিসিস পেপার যে প্রায় পুরোটাই কপি করেছিলেন, তা জানা যায়। এই দুটি ঘটনার যোগসূত্র, বাইডেনের একটি 'ডিজ-অনেস্ট' ইমেজ দাঁড় করায়। এর ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান বাইডেন। মানসিক ট্রমার মধ্যে পড়ে যান তিনি আবার। একদিকে ব্যক্তিগত ট্রাজেডি, অন্যদিকে ক্যারিয়ারের ধ্বস... অন্য কেউ হলে কী করতো, আমরা কেউ জানি না। তবে জো বাইডেন ঠিকই সামলালেন। আবারও।
যদিও নির্বাচনের এই কেলেঙ্কারি তাকে তাড়া করে ফিরেছে অনেকদিন, তবে তিনি হাল ছাড়েননি মোটেও। স্ত্রী ও কন্যার মৃত্যুর পর তিনি আস্তে আস্তে আবার নিজেকে গোছাতে শুরু করেন। জীবিত দুই সন্তানকে ঘিরে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। আরেকটি বিয়েও করেন। সে পরিবারেও বাইডেনের একটি ছেলে হয়- অ্যাশলি। জাতীয় রাজনীতিতে বাইডেন আবার আস্তে আস্তে নিয়মিত হওয়া শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও তিনি ফিরে আসতে চান। ততদিনে প্রবীণ হয়েছেন তিনি। কথাবার্তাও অনেক পরিশীলিত। মানুষ তাকে ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছিলো। কিন্তু তাও এবারেও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না বাইডেনের। বারাক ওবামা মনোনয়ন পান ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে। বারাক ওবামা আবার ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসেবে বেছে নেন জো বাইডেনকেই৷ ওবামার প্রশাসনে বাইডেন পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনেও ছিলো তার ভূমিকা।
যাই হোক, ওবামার দুই মেয়াদের পর ২০১৬ সালে যখন আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে, বাইডেন আবার নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে। কিন্তু তখনই আবার ধাক্কা। ছেলে বো বাইডেন মারা যান হুট করেই। মস্তিষ্কের ক্যান্সারে। বাবার মত বো নিজেও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ডেলাওয়ারের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে কাজ করতেন তিনি। এই মৃত্যু, জো বাইডেনকে আবার পিছিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতার জন্যে তিনি আর আবেদন করেননি। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি ফিরে আসেন আবারও। মানুষজনের অকুন্ঠ সমর্থন আদায়, কমলা হ্যারিসকে রানিং মেট করা, প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটগুলোতে সুন্দর বক্তৃতা, নির্বাচনের টানটান উত্তেজনা... শেষপর্যন্ত বিজয়।

কেউই আসলে জানতো না, আমেরিকার নির্বাচনের গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে বা যাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে অঘটন হয়ও সবচেয়ে বেশি। যোগ্য প্রার্থীরা মাঝেমধ্যেই 'উপেক্ষিত' থাকেন এখানে। সেসব দিক বিবেচনায়, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন কী না, তা সময়ের হাতেই ন্যস্ত ছিলো। তবে সব অঘটন কাটিয়ে, সব অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক একাগ্রতা, পারিবারিক একাধিক মর্মান্তিক ট্রাজেডি সামলেও তিনি শেষপর্যন্ত সেই আরাধ্য স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। এবং এসবের জন্যে তাকে কুর্নিশ না জানালে সেটি অবশ্যই ভুল হবে।এরকম নিরবিচ্ছিন্ন একাগ্রতা ও বারেবারে চেষ্টার জন্যে জো বাইডেন'কে 'আমেরিকার রবার্ট ব্রুস' ডাকা যেতেই পারে। সেটা খুব বেশি অত্যুক্তিও হবে না। বরং সেটাই খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। রবার্ট ব্রুস যেমন শেষে এসে জিতেছিলেন, বাইডেনও তো জিতলেন!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন