"গত ১৭ বছর ধরে শুনেছি আমি আনলাকি। এত দিন পরে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। অ্যান্ড আই অ্যাম অলসো ওয়ার্কিং হার্ড। আজকে কাজ ছাড়া আর কিছু নেই জীবনে। আমার স্ত্রী নীলাঞ্জনা বুঝতে পারে আমার ভিতরের এই পরিবর্তনটা। এটাও বলছি যে, আমার প্রতিটা ছবিকেই আমি কিন্তু লাকি মনে করি।"

কথাটা যীশু সেনগুপ্তের। বাবা অভিনেতা ছিলেন, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকুরী করতে মন চাইলো না, নিজেও তাই চলে এসেছিলেন লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের এই জগতে। সেই সিদ্ধান্তটার জন্যে যীশুর আফসোস হয় কিনা, সেরকমটা মুখ ফুটে স্বীকার করেননি কখনও। তবে কষ্ট তো হতোই। কষ্টের কারণটা বিশাল।

২০০২ সালে অভিষেক, তারপর থেকে একটার পর একটা সিনেমা করেছেন, কিন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি। লোকে প্রশংসা করেছে, কিন্ত হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখার গরজ অনুভব করেনি। রোমান্টিক সিনেমা করেছেন, অ্যাকশনে নাম লিখিয়েছেন, কমেডিতে লোক হাসানোর চেষ্টা চালিয়েছেন, অন্য ধারার সিনেমাও করেছেন, কিন্ত বক্স অফিসে সাফল্য আসছিল না। তাঁর পরে ক্যারিয়ার শুরু করে কতজন বিশাল তারকা হয়ে গেলেন, যীশু পাত্তাও পাননি তাদের কাছে। অথচ তাঁর ভুলটা কোথায়, সেটাও তিনি জানতেন না। চেহারা ভালো, অভিনয়টাও মন্দ নয়, লোকজন প্রশংসা করছে, কিন্ত সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দিতে ভুলতেন না, যীশু কিন্ত হিরো ম্যাটেরিয়াল নয়!  

হিরো হতে আর কী কী লাগে সেটা যীশুর নিজেরও জানা ছিল না। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি শুধু কাজটা করে গিয়েছেন, একমনে, একটানা। একটা সময়ের পরে কাজের অফার কমে আসতে লাগলো, দর্শক যাকে নিচ্ছে না, তাকে নিয়ে পরিচালকেরাই বা কী করবেন? প্রস্তাব আসতে থাকলো পার্শ্বনায়কের চরিত্রগুলোর।

একটা সময়ের পরে কাজের অফার কমে আসতে লাগলো তাঁর

যীশুর সামনে তখন একটাই রাস্তা খোলা, টিকে থাকতে হলে যা পাও তা'ই কুড়িয়ে নাও। সেটাই করতে হয়েছিল তাকে। এরমধ্যেও দারুণ সব কাজ করেছেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের 'নৌকাডুবি' বা ‘আবহমান’, তারপর ‘আর একটি প্রেমের গল্প’তে হি ওয়াজ ফ্যাবুলাস। ‘চিত্রাঙ্গদা’তে তার পারফরম্যান্সকে 'ব্রিলিয়ান্ট' ছাড়া আর কিছু তো বলা যায় না। কিন্ত ফলাফল? আগের মতোই, কোন নড়চড় নেই।

তিনি কোন গ্রুপিঙে ছিলেন না। ইন্ডাস্ট্রিতে দুটো বড় ভাগ, একভাগে ভেঙ্কটেশ ফিল্মজ, অন্যভাগে তখন এসকে মুভিজ বা অন্যান্যরা। যীশু ছিলেন স্বাধীনচেতা, এখনও আছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে যেমন তিনি কাজ করেছেন, পরের ছবিটাই হয়তো আবার করলেন অন্য হাউজে বা একদমই উল্টো ঘরানায় গিয়ে। নায়ক বা অভিনেতা হিসেবে তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকেই। তিনি তখন রিয়েলিটি শোয়ের উপস্থাপনা করেন টেলিভিশনে, কিংবা অ্যাওয়ার্ড শোয়ের মঞ্চে হোস্ট হিসেবে দেখা যায় তাকে। এসব করেই তিনি কাটিয়ে দেবেন, সেরকমটাই ভেবে রেখেছিল অনেকে। 

সেই সময়টা আসলে কেমন ছিল? একটা-দুটো দিন তো নয়, বছরের পর বছর, ঘড়ির কাঁটায় হিসেব করলে প্রায় দেড়যুগ ধরে এরকম অদ্ভুত একটা সময় পার করতে হয়েছে যীশুকে। তিনি কিন্ত ডিপ্লোমেসির ধার না ধরে অকপটে স্বীকার করেন সেই সময়ের কষ্টগুলোর কথা, বলেন- 

"১৭ বছর ধরে শুনেছি ছেলেটা ‘হেব্বি’ দেখতে, কী ব্যবহার! তার পর একদিন শুনলাম অভিনয়টাও ভাই ঠিকঠাকই করে। কিন্তু শালা আনলাকি অ্যাক্টর। এটা শুনতে শুনতে নিজের মধ্যেই একটা জেদ তৈরি করে নিয়েছি। নিজেই বলেছি, আমাকে তোমরা আনলাকি বলছ। আমি তোমাদের ভুল প্রমাণ করব।" 

দিন নাকি বদলায়। যীশুর দিনও বদলেছে। সেটা হুট করে একদিনে বদলায়নি, এক সকালে ঘুম ভেঙে নিজেকে সুপারস্টার হিসেবে আবিস্কার করেননি তিনি। এই যে এতগুলো বছর ধৈর্য্য ধরে লেগে ছিলেন, অভিনয়টা ছেড়ে প্ল্যান-বি বা সি- এর দিকে ঝুঁকে যাননি, সেই একাগ্রতা আর হাল না ছাড়ার মানসিকতাটাই তাঁকে লড়াইয়ে টিকিয়ে রেখেছিল।

এই লড়াই জাতে ওঠার লড়াই নয়, অন্য নায়কদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইও নয়। লড়াইটা ছিল নিজের সঙ্গে, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। নিজেকে প্রমাণ করার, যারা তাঁকে 'আনলাকি' খেতাব দিয়েছিল তাদের দেখিয়ে দেয়ার তীব্র একটা জেদ ছিল নিজের মধ্যে। সেই জেদটাই আগুনের ফুলকি হয়ে পারফরম্যান্স হিসেবে বেরিয়ে এসেছে তার ভেতর থেকে।

'এক যে ছিল রাজা'র যিশু

২০১৪-তে এলো জাতিস্মর, সেখানেও সবটুকু আলো কেড়ে নিলেন প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় আর সৃজিত মূখার্জী। তবুও নিজের ছাপটুকু মুছে যেতে দেননি যীশু। এর আগে বলিউডের 'বারফি'তে ছোট্ট একটা রোলে দেখা গিয়েছিল তাকে, বাঙালী পরিচালক অনুরাগ বসু নিয়েছিলেন তাকে। মারদানীতেও ছোট রোলে ছিলেন। এরপর অঞ্জন দত্ত তাকে নিয়ে বানালেন ব্যোমকেশ। সেখান থেকেই বদলে যাওয়ার শুরুটা, সবচেয়ে বড় ব্রেক-থ্রু। এরপর এলো রাজকাহিনী, সেটাও সৃজিতের। এই সিনেমার 'কবীর' নামের নেগেটিভ রোলটা যীশুর ভীষণ পছন্দের। 

তারপর থেকে টানা সিনেমা করেই চলেছেন। জুলফিকার, কেলোর কীর্তি, ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা, বংস এগেইন, পোস্ত, ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ, ঘরে বাইরে, উমা... সিরিয়ালটা লম্বা হচ্ছে কেবল। গত পূজোয় মুক্তি পেলো ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সৃজিতের নতুন সিনেমা 'এক যে ছিল রাজা', সেখানেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে তিনিই আছেন। এই সিনেমায় তাঁর বেশভূষা দেখে চমকে উঠেছে সবাই! সিনেমাটা নিয়ে প্রশংসা না হলেও, যীশুর প্রশংসা করেছেন সবাই।

বলিউডে দীপিকা আর ইরফানের সঙ্গে পিকু-তে দেখা গেছে তাকে, কঙ্গনা রনৌতের সবশেষ সিনেমা মনিকর্ণিকা'তেও রোল আছে তাঁর। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন যীশু, অতটা ব্যস্ত মনে হয় গত ষোল-সতেরো বছরের ফিল্মি ক্যারিয়ারে তিনি কখনোই ছিলেন না। যে সময়টা যীশু পেরিয়েছেন, যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, যেভাবে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কেটে গিয়েছেন, সেটা অসম্ভব মনের জোর না থাকলে কেউ পারে না।

বরাবরই ডিরেক্টর'স আর্টিস্ট তিনি, পারফরম্যান্স দিয়ে পরিচালককে সর্বোচ্চ সন্তুষ্ট করাটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আবহমান সিনেমায় একটা সিন ভুল করায় ঋতুপর্ণ ঘোষ যিশুকে এক ঘণ্টা দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন! তাতে যীশুর আপত্তি ছিল না কোন। 

বরাবরই তিনি ডিরেক্টর'স আর্টিস্ট

যীশু সেনগুপ্তের ডেডিকেশন লেভেলটা কেমন, সেটা জয়া আহসানের মুখেই শোনা যাক। একটা আড্ডায় 'এক যে ছিল রাজা'তে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জয়া আহসান বলছিলেন- 

"যীশু এই সিনেমাতে যা করেছে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। তীব্র শীতের সময় এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল। সিনেমাতে নারীদের দেখা যাবে শাড়ি পরা অবস্থায়, কিন্তু শাড়ির ভেতরেও আমরা আরও যত গরম কাপড় পেঁচিয়ে পরা যায়, সেগুলো পরেছিলাম। এরপরেও শীতে কাঁপছিলাম বলতে গেলে!
কিন্তু যীশু? ও মাই গড! একটা নেংটির মতো পাতলা জিনিস পরে এই শীতে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওর মেকাপ চলত, আর সেটা উঠাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই তীব্র শীতে নদীর পানিতে সৃজিত যীশুকে বলছিল- পানিতে ডুব দে।দিতে থাক। একটাবারও মুখে একটা শব্দও করেনি যীশু এই শীতে। সৃজিতের শট ওকে না হওয়া পর্যন্ত জাস্ট একটা নেংটি পরে সে এই কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে ডুব দিয়ে গেছে!" 

এই ডেডিকেশনটাই যীশুকে টিকিয়ে রেখেছে, তার হাতে সাফল্য ধরিয়ে দিয়েছে। যে মানুষটার সিনেমা টানা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে, 'আনলাকি' অপবাদ দিয়ে যাকে নিয়ে পরিচালকেরা পার্শচরিত্রের কাজও করাতে চাইতেন না, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেই যার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে বলে মত দিয়েছিলেন অনেকে, সেই যীশু সেনগুপ্ত এখন টালিউডের সবচেয়ে ব্যস্ত অভিনেতা।

সৃজিত মূখার্জীর মতো পরিচালক একের পর এক তাকে লিড আর্টিস্ট হিসেবে কাস্ট করে সিনেমা বানিয়ে যান, শিবু-নন্দিতা থেকে শুরু করে অঞ্জন বা মৈনাক, সবার চাহিদার শীর্ষে থাকেন তিনি! এই পটবদলটা এমনি এমনি তো হয় না। যীশু সেনগুপ্ত বলেই হয়তো পেরেছেন, অন্য অনেকে হাল ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক আগেই ভেগে যেতেন!  

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- আনন্দবাজার পত্রিকা, সৈয়দ নাজমুস সাকিব


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা