সারাদিন পাকিস্তানকে গালি দিয়ে ভারতকে সেই পাকিস্তানের মতোই ধর্মভিত্তিক দেশ বানানোর পথে হাঁটছেন অমিত শাহ। জিন্নাহরা মরে না, অমিত শাহ'দের মাঝে বেঁচে থাকে তাদের ভূত, এটাই বোধহয় চিরসত্যি।
একদিকে আন্দোলনের ঢল। দিল্লি-কলকাতা-চণ্ডিগড়-বেঙ্গালোর, কিংবা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসাম- কোথায় নেই আন্দোলন? ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে, তৈরি হয়েছে ভারত-পাকিস্তান, পরিকল্পনাটা ছিল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ'র। ২০১৯ সালে এসে ভারতকে ধর্মের বিভাজনে দুই টুকরো করার প্রয়াস নিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী এক জিন্নাহ, নাম তার অমিত শাহ। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতিও। সিটিজেনশীপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল নিয়ে তুমুল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আর মানুষের মৃত্যুর পরও যিনি গলা উঁচিয়ে বলে যাচ্ছেন- 'সিএবি হোগা, উসকে বাদ এনআরসি আয়েগা' (সিএবি তো হবেই, তারপর ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস টাও আসবে)!
বিতর্কিত এই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন-সহ মোট ছয় ধর্মের মানুষ যারা নিজ দেশে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে এসেছেন, তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এখানে শুধু মুসলমানদের নামই বাদ গেছে, বাকী সব ধর্মই কিন্ত আছে! পাকিস্তানে যদি শিখ আর হিন্দুরা নির্যাতিত হয়, তাহলে মিয়ানমারেও তো রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে, চীনে উইঘুরদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। তাদের কেন আশ্রয় দেয়া হবে না? কারণ, তারা মুসলমান!
আর এনআরসি নামের নতুন উপদ্রবে বলা হয়েছে, ভারতে অবস্থানকারী প্রত্যেকটি মানুষকে তার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। সেটা শুধু পাসপোর্ট, আইডি কার্ড বা স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট দিলেই হবে না। বাবা-দাদার নাগিরিকত্বের প্রমাণও দিতে হবে। ১৯৭১ সালের আগে থেকে তারা ভারতে বাস করে, এমন দলিলপত্র হাজির করতে হবে। এত পুরনো দলিল কে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে আজকাল? বিশেষ করে গরীব আর অশিক্ষিত মানুষ যারা, তারা তো কাগজপত্রের ঝুট-ঝামেলায় যেতেই চায় না। ভারতের অনেক জায়গায় মুখে মুখেই জমিজমা ভাগ হয়ে যায়, তার ওপরে নারীরা পান না সম্পত্তির ভাগ, কাজেই কাগজপত্র তারা আনবেন কোত্থেকে? কিন্ত অমিত শাহ বলে দিয়েছেন, যথাযথ প্রমাণ না দিতে পারলে তার জায়গা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে!
হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একেকটা ডিটেনশান ক্যাম্প বানানো হচ্ছে, নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া মানুষগুলোকে রাখা হবে সেখানে? কিন্ত কয়জনকে রাখবে ভারত সরকার? আসামে ইতিমধ্যেই এনআরসি হয়েছে এক দফা, সোয়া তিন কোটি জনসংখ্যার মধ্যে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। তাহলে পুরো ভারতে এই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? প্রায় নয় থেকে দশ কোটিতে। এরমধ্যে আশি ভাগই হিন্দু। তাদেরকে আবার সিটিজেনশীপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়া হবে, কিন্ত সেই সুবিধাটা পাবেন না মুসলিমরা। শত শত বছর ধরে ভারতে থেকেও, শুধুমাত্র কাগজপত্রের অভাবে তারা বিতাড়িত হবেন ভারত থেকে!
লোকসভা ভোটে বিজেপি জিতেছে ৩০৩টি আসনে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল দলটি। বাকীরা খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে তাদের সামনে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু হয়ে গেছে তাদের। অমিত শাহ গতবার মন্ত্রীত্ব নেননি, দল সামলেছেন। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসেই শুরু করেছেন তাণ্ডব। প্রথমে কাশ্মিরের ওপর আর্টিকেল ৩৭০ চাপিয়ে দিলেন, তারপর অযোধ্যার রায় এলো, সেটাও মন্দিরের পক্ষে। এবার তো মুসলমানদের দেশছাড়া করার মাস্টারপ্ল্যানই বানিয়ে ফেলা হলো!
নরেন্দ্র মোদি রামলীলা ময়দানের ভাষণে বারবার বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই, ভারতের নাগরিকেরা কোন সমস্যায় পড়বে না, সিএবির কারণে মুসলমানদেরও কোন অসুবিধা হবে না। অমিত শাহ নিজেও একই কথা বলেছেন বারবার। কিন্ত বিশ্বাস কি আর এত সহজে আসে? ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই। নিজেদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রূপটা এত বেশি প্রকাশ করেছেন মোদি-শাহ জুটি আর তাদের দল বিজেপি, তাদের ওপর মুসলমানেরা ভরসা রাখার কথা ভাবতেও পারে না।
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদটা শুরু করেছিলেন জিন্নাহ, সৃষ্টি করেছিলেন পাকিস্তানের, যে দেশটা নিজেদের 'মুসলিম দেশ' হিসেবে পরিচয় দেয়। সেই মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে যতো অনাচার হয়, সেটা ইজরাইলেও হয় না। পৃথিবীর বুকে এক টুকরো ক্যান্সার হয়েই টিকে রয়েছে পাকিস্তান। সারাদিন পাকিস্তানকে গালি দিয়ে ভারতকে সেই পাকিস্তানের মতোই ধর্মভিত্তিক দেশ বানানোর পথে হাঁটছেন অমিত শাহও। জিন্নাহরা মরে না, অমিত শাহ'দের মাঝে বেঁচে থাকে তাদের ভূত, এটাই বোধহয় চিরসত্যি।