মা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি, সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। ছেলে দেয়াল বেয়ে চড়ে বসেছেন জানালায়, কাঁচের ফাঁক দিয়ে মাকে যদি একবার দেখা যায়, একটাবার শুধু...

করোনার এই ক্রান্তিকাল আমাদের মানুষ চেনাচ্ছে প্রতিদিন।  মানুষের মুখোশগুলো খুলে যাচ্ছে ক্রমশ, নিয়মিতই বিস্মিত হচ্ছি আমরা। চমকে উঠছি, আঁতকে উঠছি মানুষের ভয়ঙ্কর স্বরূপ দেখে। অজস্র মানুষের পঙ্কিল অবয়ব দেখতে দেখতে আমরা সবাই বোধহয় ক্লান্তও।

এই ক্লান্তিকর সময়ের মধ্যে আমরা এমন সব কষ্টের মুহূর্ত দেখছি, কষ্টের গল্প পড়ছি, বুকের কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে কান্না। কোথায় যেন মোচড় দিচ্ছে অব্যক্ত এক অনুভূতি। আমরা বুঝতে পারছি করোনা সবাইকে শারীরিকভাবে ছুঁতে না পারলেও, মানসিকভাবে আমাদের করে দিচ্ছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। করোনার মানসিক সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা সবাই। কেউ রেহাই পাচ্ছি না। যেন এক পাংশু পাণ্ডুলিপির চরিত্রতে পরিণত হয়েছি আমরা সবাই। যেন এক বিবর্ণ ক্যানভাসে ছাই রঙা তুলি সবাই। তবুও এই বিবর্ণ ক্যানভাসে আজকে এমন এক গল্প বলছি যে গল্প তীব্র বাস্তবতার, স্বজনহারানো বেদনার, আবার একই সাথে নিখাদ ভালোবাসার। যে গল্প অন্দরমহলের কোথায় যেন খালি করে দিয়ে যায় শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পরে শূন্য-বিরান প্ল্যাটফর্মের মতন। 

সম্প্রতি একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব আলোড়ন তুলেছে। ফিলিস্তিনের এক তরুণ হাসপাতালের কয়েক তলা দেয়াল বেঁয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। এরপর একটি কাঁচঘেরা জানালার ওপাশে বসে দেখছে কিছু একটা। স্থির হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকছে এক জায়গাতেই। এই ছবিটা তুলে সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে দেন ঐ হাসপাতালেই অবস্থানরত আরেকজন। জানা যায়- ফিলিস্তিনি এই তরুণটির নাম জিহাদ আল সুয়াইতি।

মায়ের লিউকেমিয়া ক্যান্সার ছিলো আগেই। গত পাঁচদিন ধরে করোনায় আক্রান্ত  মা। রাখা হয়েছে হেব্রন স্টেট হাসপাতালের 'ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট' এ। মায়ের কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই। ডাক্তাররা ঢুকতে দিচ্ছে না। ছেলে মায়ের মুখ ভুলতে পারছে না। হাসপাতালের দেয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছে হাসপাতালের মায়ের রুমের পাশের জানালার পাশে। ঠাঁয় বসে থাকছে। দেখছে মা'কে। অজস্র তারের কুণ্ডলী লতার মতো জড়িয়ে শুয়ে আছে যে মা। প্রিয়মুখটা দেখবার কী আকুতি! বিচ্ছেদের বেদনায় কত ভয়! নিজের বিপদের তোয়াক্কা না করে বিপজ্জনকভাবে জানালার পাশে বসে থাকা। মায়ের মুখ একবার শুধু দেখার ইচ্ছে। প্রতিদিন উঠে যাওয়া দেয়াল বেয়ে। 

মাকে এক নজর দেখার চেষ্টা করছেন জিহাদ

মা বাঁচেননি। ৭৩ বছর বয়সী হৃদযন্ত্র হুট করেই নিয়ে নিয়েছে অবসর। মা কিনেছেন ট্রেনের সেই টিকেট, যে টিকেটে আর ফিরে আসা যায় না। ওদিকে ছেলে তখনো ঠাঁয় বসে আছে কাঁচের জানালার ওপাশে। মায়ের মুখ একবার দেখার আশায়। মাত্র একবার। 

মহামারী রূপান্তরিত হয়েছে বায়োস্কোপে, বায়োস্কোপের পর্দা হয়ে প্রতেকদিনই আমাদের দেখাচ্ছে অজস্র সব গল্প। বিভিন্ন বৈচিত্র‍্যের গল্প। কোনো গল্পে স্বজনের লাশ নিতে কেউ না আসার দৃশ্য। সাদা লাশ মুখব্যাদান অবহেলায় পড়ে থাকার দৃশ্য। কোনো দৃশ্যে রয়েছে করোনার ভয়ে স্বজনকে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার গল্প । রয়েছে মা'কে শেষবারের মতো দেখার আকাঙ্ক্ষায় কয়েক তলা হাসপাতালের দেয়াল বেয়ে উঠে জানালার ওপাশে কারো কারো ঠাঁয় বসে থাকারও আখ্যান।

আমাদের কারোরই জানা নেই- এই মহামারী, এই প্রলয় কবে থামবে। তবে আমরা বোধহয় আর নিতে পারছি না। আমাদের হৃদয়যন্ত্র এত চাপ সামলাতে পারছে না আর। আমরা ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সমাধান খুঁজে পাচ্ছিনা কেউ। যে ঝড় শুরু হয়েছে, তা থামারও কোনো লক্ষ্মন দেখছি না। এভাবে আর কতদিন, কেউ জানি না। কেউ জানেও না। আমাদের অন্দরমহল তাসের ঘর হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতিদিন। 

আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমরা কোথায় ছিলাম৷ কোথায় আছি। যাবোটাই বা কোথায়! 

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা