জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে ফ্রেমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এই চলচ্চিত্রটি কেবল চলচ্চিত্র নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নসনদ, একটি 'ওয়েক আপ কল'।

চলচ্চিত্রের নাম: জীবন থেকে নেয়া 
পরিচালক: জহির রায়হান 
কাহিনী: আমজাদ হোসেন 
মুক্তির সন: ১৯৭০, ১০ এপ্রিল (পাকিস্তান) 
ডিউরেশন: ১ ঘন্টা ৫০মিঃ (প্রায়) 
সঙ্গীত পরিচালক: খান আতাউর রহমান 
চিত্র গ্রহণ: আফজাল চৌধুরী 
সম্পাদনা: মলয় বন্দ্যোপাধ্যায় 
পরিবেশক: আনিস ফিল্ম 
দেশ: বাংলাদেশ 
ভাষা: বাংলা 
রঙ: সাদা-কালো 
অভিনয়: 

রাজ্জাক
সুচন্দা
আনোয়ার হোসেন
শওকত আকবর
রোজি সামাদ
খান আতাউর রহমান
রওশন জামিল
বেবি জামান
আমজাদ

ঢাকার গুলিস্তান হলের সামনে প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছে। পাক আর্মি এসে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের রিল জব্দ করে নিয়ে গিয়েছে। মুক্তির প্রথম দিনই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সকল প্রদর্শনী। জহির রায়হানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাঁর এত কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা কি সব বিফলে যাবে? আমজাদ হোসেন ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন সামনেই।

এরই মাঝে খবর এল, আন্দোলনের মুখে পুনরায় সেন্সর বোর্ডে কাল দেখানো হবে চলচ্চিত্রটি। এবং সেন্সর বোর্ডে উপস্থিত থাকবেন খোদ ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলি! এই রাও ফরমান আলি, মেজর মালেক এবং তাদের তাঁবেদাররাই চক্রান্ত করছে এই চলচ্চিত্রটি যেন কোনভাবেই আলোর মুখ না দেখে। কারণ তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে পলিটিকাল স্যাটায়ারধর্মী এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মূলত এই দেশের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন জহির রায়হান ও তাঁর দল। কাল সেন্সর বোর্ডে যেভাবেই হোক তারা আটকে দিতে চাইবে এই চলচ্চিত্রটিকে। 

এর আগেও ১৯৬৫-৬৬ সালে জহির রায়হান “একুশে ফেব্রুয়ারি” চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরু করেও শেষ করতে পারেননি সরকারের বাধায়। এবার আর তিনি পিছু হটবেন না। তিনি আমজাদ হোসেনকে ডেকে বললেন, 'আমাদের যদি কেউ বাঁচাতে পারে তবে তিনি আসকার ইবনে সাইক। আসকার ইবনে সাইক একজন নাট্যকার এবং সেন্সর বোর্ডের প্রধান সদস্যও ছিলেন। আমজাদ হোসেনের এলাকার মানুষ হওয়ায় আমজাদই তাঁর কাছে গেলেন এবং অনুরোধ করলেন যেন তিনি কাল সেন্সর বোর্ডে যান।

পর দিন সেন্সর বোর্ডে সবার মাঝে উৎকণ্ঠা। চলচ্চিত্রটি যখন শেষ হলো, তখন গোঁটা রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। রাও ফরমান আলী মুখ শক্ত করে বসে আছেন তখনো। চেয়ারম্যান সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কী মনে করে আসকার ইবনে সাইককে বললেন- আপনি বলেন। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর দাঁড়ালেন। সবার মুখের দিকে একবার চেয়ে বললেন, ‘স্যার পবিত্র কোরআনে কোন মিথ্যে কথা বলা নেই। মিথ্যে কথা বলবার কোন সুযোগও সেখানে দেয়া হয়নি। জহির হয়ত ভুল করে একটা সত্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে।এই সত্যকে আমি কীভাবে মিথ্যা বলি!’

কেউ আর কোন কথা বলল না। ছবিটি মুক্তি পেল। তবে প্রজেকশন শেষে রাও ফরমান জহিরকে বললেন, ‘ছবিটি ছেড়ে দিলাম। বাট আই উইল সি ইউ!’ তারপর মুক্তি পেল “জীবন থেকে নেয়া”। গড়ল ইতিহাস। এই প্রথম বাঙালি কোনো চলচ্চিত্র দেখার অধিকার আদায়ে আন্দোলন করল। আর জোরেশোরে একটা চপেটাঘাত পড়লো ওই স্বৈরাচারীদের গালে।

বাঙালি এই প্রথম কোনো চলচ্চিত্র দেখার অধিকার আদায়ে আন্দোলন করে

সময়টা ১৯৬৯ সাল। বিহারী প্রযোজক আনিস দোসানি ডাকলেন জহির রায়হানকে একটি চলচ্চিত্র বানানোর জন্য। এর আগেও জহির রায়হান সঙ্গম, কাঁচের দেয়াল, বাহানা, আনোয়ারা, টাকা আনা পাই- এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। আনিস কেবল প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু জহির রায়হান যে কী ধরণের ছবি বানাতে চাচ্ছিলেন, তা সম্পর্কে কখনো তিনি ধারণাও করতে পারেননি।

জহির রায়হান চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিলেন তরুণ লেখক আমজাদ হোসেনকে। তিনি একটি দৃশ্য বুঝিয়েও দিলেন যে- এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াচ্ছে। আমজাদ হোসেন চমকে গেলেন! বললেন- এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াচ্ছে, এটা কি দর্শক ভালোভাবে নেবে? জহির নিজ অবস্থানে অনড় রইলেন। এভাবেই পারিবারিক একটি গল্প নিয়ে চিত্রনাট্যের কাজ এগুচ্ছিল।

এরই মাঝে একদিন মাওলানা ভাসানি ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানানোর দায়িত্ব দেন তারই দলের সদস্য আমজাদ হোসেনকে। পরে সরকারের চাপে আসাদের পরিবার আমজাদ হোসেনকে অনুরোধ করেন ডকুমেন্টারিটি না বানানোর জন্য। কিন্তু আমজাদ হোসেনের মাথায় তো তখন বিদ্রোহ ঢুকে গেছে! তিনি জহির রায়হানের জন্য লেখা পারিবারিক গল্পটিতে রূপকভাবে যেন সেই স্বৈরাচার, আন্দোলন আর বিপ্লবকেই তুলে আনেন। এদিকে জহির রায়হানও ছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম দশজন কারাবরণকারীদের মাঝে একজন। তিনি দেখলেন যে গল্প রাজনীতির দিকে মোড় নিচ্ছে। তারপর তিনি আর আমজাদ হোসেন মিলে একটি অসাধারণ চিত্রনাট্য দাঁড় করালেন।

জহির রায়হান

কিন্তু এমন সাহসী চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের জন্যও তো সাহসী অভিনেতা প্রয়োজন। গওহর জামিলের স্ত্রী রওশন জামিল তখন নৃত্যশিল্পী। কিন্তু জহির রায়হান তাঁর জহুরির চোখে চিনে ফেললেন যেন তার মাঝের অভিনেত্রীকে। তাই পরিবারের স্বৈরাচারী গিন্নির শক্তিশালী চরিত্রটি তিনি তাকেই দিলেন। একে একে রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, খান আতা, বেবি জামান, রোজি সামাদ প্রমুখ সবাই যুক্ত হলেন এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে। জহির রায়হানের বাসায় যখন গোপন মিটিং বসতো, তখন সবার চোখে-মুখে যেন বিপ্লবি আভা খেলা করতো! সবার মুখে একই কথা- এ দেশের জন্য এতো মানুষ প্রাণ দিয়েছে, আর আমরা একটু ঝুঁকি নিয়ে অভিনয় করতে পারবো না? 

চলচ্চিত্রের নাম ততদিন পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল “তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ”। কিন্তু নামেও যে একটা প্রতীকী অর্থ থাকতে হবে সেটা জহির রায়হান বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি নাম বদলে চলচ্চিত্রটির নাম রাখলেন “জীবন থেকে নেয়া”।এ তো বাঙালির জীবন থেকে নেয়া উপজীব্য দিয়েই সৃষ্ট চলচ্চিত্র! এর চেয়ে যথাযথ নাম বোধহয় আর হতে পারতো না। 

চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্র ছিল যেন তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক একেকটি ঘটনার রূপক চরিত্র। আনোয়ার হোসেন ছিলেন যেমন কোন এক রাজনৈতিক দলের তেজস্বী নেতা, তেমনি রাজ্জাক যেন প্রতিবাদী ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি। রওশন জামিলের স্বৈরাচারী মনোভাব আর শোষণের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারনীতি। আর খান আতা যেন শোষিত, কিন্তু স্বাধীন চেতনার প্রতীক। 

চলচ্চিত্রের গল্পটি সাজানো হয় উগ্রচণ্ডী দজ্জাল বড় বোন রওশন জামিলের নির্যাতনে স্বামী খান আতাউর রহমান নিষ্পেষিত অবস্থা, দুই ভাই শওকত আকবর ও রাজ্জাক, দুই ভাইবধূ রোজী ও সুচন্দা এবং বাড়ীর চাকর বাকর ও রোজী–সুচন্দার বড় ভাই দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে। 

পুরো বাড়ীতে স্বৈরাচারী বড় বোন রওশন জামিলের একচ্ছত্র আধিপত্য চলতে থাকা অবস্থায় দুই ভাই বিয়ে করে। এরপর নববধূদের সংসারে প্রবেশ এবং পরবর্তীতে সংসারের চাবির গোছা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার কূটকৌশল চরমে পৌঁছে, যার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইয়াহিয়া/আইয়ুব খানের শোষণ ও ক্ষমতায় থাকার কূট কৌশলের রুপক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন জহির রায়হান।

জেলের ভেতর ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান গাওয়ার দৃশ্য

অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম জেল-জুলুম এর বাস্তব চিত্র ছিল ছবিটিতে। আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর জেলের ভেতর থাকা অবস্থায় নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির ব্যবহার মূলত আন্দোলনে থাকা বাঙ্গালিদের উৎসাহ যোগান দেয়ার চিত্র। নবজাতক এর নাম ‘মুক্তি’ রুপক অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও শোষকের হাত থেকে মুক্তির বহিঃপ্রকাশ।

ছাত্রনেতা ইকবালের গ্রেফতার হয়ে কারাগারে প্রবেশ এর সময় উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার উৎসাহের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত, যার সবই ছিল জহির রায়হান এর দূরদর্শী সৃষ্টি।

এভাবেই জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে ফ্রেমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এই চলচ্চিত্র ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি “ওয়েক আপ কল”। বাঙালীদের জাগিয়ে দেবার জন্য এরকম একটা ধাক্কার প্রয়োজন ছিল খুব সেই সময়। জহির রায়হান এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যেন এঁকে দিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালির চোখে।

পরবর্তীতে এই চলচ্চিত্র থেকে আয় করা সব টাকা তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে দান করেন অথচ সেই সময় তার খাবার টাকা পর্যন্ত ছিল না পকেটে। এই চলচ্চিত্রটি কেবল চলচ্চিত্র নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নসনদ, জহির রায়হান ছিলেন বাঙালির সেই মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। এই চলচ্চিত্রটি আসলেই বাঙালির “জীবন থেকে নেয়া”; যার স্লোগান ছিল-

"একটি দেশ 
একটি সংসার,
একটি চাবির গোছা 
একটি আন্দোলন,
একটি চলচ্চিত্র"

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা