জীবনানন্দ দাশ নামের নক্ষত্রটির আয়ু অসীম। যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, ততদিন জীবনানন্দ থাকবে। বারবার ফিরে আসবে আরো 'সুন্দর করুণ' ভাবে।

ধরুন আপনি দেখলেন একটা শালিক মাঠের ঘাসে পা ডুবিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ উড়ে গিয়ে পাশেই একটা হিজল গাছের ডালে গিয়ে বসলো। প্রথমেই, ধরে নিতে হচ্ছে আপনি আসলেই ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। কারণ ৯৯ ভাগ সম্ভাবনা যে, আপনি ব্যাপারটা লক্ষই করেননি। তো এই গোটা ঘটনাটা আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন? হয়তো বলবেন, "আমি দেখলাম একটা শালিক মাঠে হাঁটছিল, হঠাৎ সে উড়ে গিয়ে হিজল গাছে বসলো।"

আসুন দেখি, জীবনানন্দ ঘটনাটা বর্ণনা করছেন কীভাবে- "দেখিব খয়েরি ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে, ধবল রোমের নীচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;" 

জীবনানন্দের কবিতার ভাষা খুব কঠিন নয়, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দগুলোই সেখানে এসেছে। কিন্তু এসেছে অদ্ভূতভাবে। অদ্ভূত সুন্দরভাবে। শালিকের উড়ে গিয়ে গাছে বসার মতো সাধারণ একটা ব্যাপার, কিন্তু কী অতিমানবিকভাবেই না সেটা প্রকাশ করেছেন। দেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন 'সবচেয়ে সুন্দর করুণ'। করুণ এর সাথে সুন্দর যোগ করে মাত্র দুটি শব্দেই তিনি এই দেশের প্রকৃতিটা বুঝিয়ে দিলেন। তিনিই বলেছিলেন 'উপমাই কবিতা'। উপমার এমন অদ্ভুত, অসাধারণ এবং সৃজনশীল প্রয়োগ বাংলার খুব কম কবিই করতে পেরেছেন।

"চারি দিকে এখন সকাল- রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল!" "চারি দিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!" "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; " "তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!" এমন অসংখ্য অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়, এর থেকে আরো চমৎকার সব উদাহরণ দেয়া যায়। আমি শুধু হাতের কাছে থাকা কয়েকটি তুলে দিলাম মাত্র।

শুধু কি উপমার কারণে জীবনানন্দের কবিতা অসাধারণ? না, শুধু উপমাই মূল কারণ হলে সেটা উপমার ডিপো হতো ঠিকই, কিন্তু কালোত্তীর্ণ হতো না। আমি আপনাদের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটা পড়তে বলবো, যারা পড়েননি। যারা পড়েছেন, তারা জানেন, এটা কী অদ্ভুত একটা কবিতা। কী পরাবাস্তব এক অনুভূতি হয় এই কবিতাটা পড়লে। জীবনানন্দের কবিতা সুদৃশ্য সাজানো লেকের জল নয়, উত্তাল সমুদ্র। কবিতা পড়তে পড়তে হঠাৎ করে কোনো এক লাইনে এসে আপনি চমকে উঠবেন। চমকে গিয়ে থমকে যাবেন। বইয়ের পাতা থেকে মাথা তুলে একবার ভাববেন 'এটা কী বলল!' এরপর ঐ লাইনটা আবার পড়বেন, ভাববেন, আলোড়িত হবেন।

তরুণ জীবনানন্দ দাশ

বাংলায় আধুনিক কবিতার দিকপাল ত্রিশের দশকের পাঁচ মহৎ কবি- জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে- এঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশকে আমার শ্রেষ্ঠ মনে হয়। অবশ্য, এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মত, হয়তো জীবনানন্দের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ফল। বুদ্ধদেব বসুর কথাও বলা যায়, তবে তিনি সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পারদর্শী ছিলেন। সেদিক থেকে জীবনানন্দ ছিলেন 'বিশুদ্ধ কবি'। বুদ্ধদেব বসুই তাঁকে 'শুদ্ধতম কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। জীবনানন্দ যদিও কিছু উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন ছোট গল্প এবং কিছু প্রবন্ধ- তবে তাঁর কবিতার কাছে সেগুলো জৌলুশহীন।

অসাধারণ প্রতিভাবান এই মানুষটিকে সারাটা জীবন কাটাতে হয়েছে ভীষণ অভাব-অনটনের সাথে, অনেক কষ্টে। এই মানুষটি যদি রবীন্দ্রনাথের মতো পরিবেশ পেতেন, তাহলে হয়তো তিনিই হতেন বাংলার প্রধানতম কবি। জীবনানন্দের জীবন সম্পর্কে জানতে সহায়ক বই হিসেবে শাহাদুজ্জামানের 'একজন কমলালেবু' বইটি পড়তে অনুরোধ করব। মানুষ জীবনানন্দকে তাহলে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যাবে। 

ব্যক্তিগতভাবে আঞ্চলিকতা নিয়ে আমি কখনো মিথ্যে গর্ব প্রদর্শন করি না। কিন্তু বরিশালে 'জীবনানন্দ দাশ সড়ক' দিয়ে হেঁটে যাবার সময় এক ধরণের আনন্দ হয়। আহা! এই মাটিতে একদা জীবনানন্দ ছিলেন। তবে কষ্টও হয়। বরিশালে তাঁর স্মরণে যেরকম আয়োজন থাকার কথা ছিল, সেটা একদমই নেই। এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ-প্রতিভাটিকে এখানকার মানুষ ঠিকভাবে চেনে না। আমি বরিশালে গেলে অতি আগ্রহ নিয়ে বারবার জীবনানন্দের পৈত্রিক বাড়ি, বিএম কলেজে যেখানে জীবনানন্দ পড়াতেন এবং বরিশাল মহাশশ্মানে যেখানে 'আট বছর আগের একদিন' এর সেই লাশকাটা ঘরটা ছিল- সেখানে যাই। কেন যাই জানি না, তবে এক ধরণের রোমাঞ্চ হয়- এখানে জীবনানন্দ ছিলেন!

শত বছরের ইতিহাসে একজন মাত্র মানুষ কলকাতায় ট্রামের তলায় পড়ে মারা গিয়েছে, তিনি জীবনানন্দ। অনেকে মনে করে এটা আত্মহত্যা ছিল। সে সময়ে তাঁর যে দূরাবস্থা ছিল, তাতে সেটা অস্বাভাবিক নয়। আত্মহত্যা না হলেও তিনি অবশ্যই অন্যমনস্ক ছিলেন। সেই অন্যমনস্কতা কিন্তু কবি-সুলভ অন্যমনস্কতা নয়, একজন অভাবী সংগ্রামী মানুষের অন্যমনস্কতা।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্রতিভাটিকে সে সময়ের মানুষেরা, সেই সমাজ রক্ষা করতে পারেনি। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৪ অক্টোবর। এর কিছুদিন পর ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্রটি ঝড়ে পড়ে। 

"মানুষেরও আয়ু শেষ হয়! পৃথিবীর পুরানো সে পথ মুছে ফেলে রেখা তার- কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়! সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব,- নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়।" কিন্তু জীবনানন্দ দাশ নামের নক্ষত্রটির আয়ু অসীম। যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, ততদিন জীবনানন্দ থাকবে। বারবার ফিরে আসবে আরো 'সুন্দর করুণ' ভাবে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা