বাংলাদেশে প্রায় দুই মাস ছিলেন জেসন বিল্লাম। ২২ বছর বয়সেই বিশ্বের ২৮টি দেশ ভ্রমণ করে ফেলা এই ট্র্যাভেলারের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে স্বীকৃতি পেয়েছিল, সেটি কিন্ত একদম ফেলনা নয়!
তানযীর হাসান:
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের দেশে আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত, পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন, অসংখ্য অপরুপ ঝর্ণা, পাহাড়, নদী, হাওড়। এছাড়াও আছে অসংখ্য প্রাচীন পুরাকীর্তি, যেগুলো আমাদের গৌরবময় অতীত ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। অর্থাৎ, পর্যটক আকর্ষণের জন্য যা যা দরকার তার সবই আছে আমাদের। তারপরও আমাদের পর্যটন শিল্প অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে বাংলাদেশ খুবই ব্যর্থ। সারা বিশ্বে যেসব দেশে পর্যটকেরা সবচেয়ে কম ভ্রমণ করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। অপার সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন খাতের এই চিত্র সত্যি হতাশাজনক।
বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছিলেন ব্রিটিশ পর্যটক এবং ইউটিউব ভ্লগার জেসন বিল্লাম। মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি ভ্রমণ করেছেন ২৮ টি দেশ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। ২ মাস বাংলাদেশে অবস্থান করে সেবছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি ফিরে যান। কেমন ছিলো তার বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা?
বাংলাদেশে অবস্থানকালে জেসনের ভ্রমণের তালিকায় ছিলো জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, লালবাগ কেল্লা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পানাম নগর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সুন্দরবন, লালাখাল, সুনামগঞ্জের শিমুল বাগান, শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, বাগেরহাট, নওগাঁ। ইউটিউবে তার নিজস্ব চ্যানেলে বাংলাদেশ নিয়ে জেসন আপলোড করেছেন ২১ টি ভিডিও।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু জেসন ২ মাস বাংলাদেশে অবস্থানকালীন হোটেল ভাড়ায় খরচ করেছেন মাত্র ২ হাজার টাকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবস্থান করেছেন স্থানীয় কারো বাসায়। কোনো প্রফেশনাল গাইডের সাহায্য নেন নি, বেশিরভাগ জায়গাতে একাই ভ্রমণ করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে যাদের সাথে ছিলেন তাদের সাহায্য নিয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা জেসনকে খুবই আপ্লুত করেছে। যেখানেই গেছেন সেখানেই মানুষ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে, এগিয়ে এসে আলাপ জমিয়েছে। রাস্তায় যেকোনো প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য উৎসাহী লোকের অভাব হয় নি। কখনোবা তাকে চা-নাস্তার জন্য বাসায় নিমন্ত্রণও করা হয়েছে। ফিরে যাওয়ার আগে জেসন জানিয়ে গেছেন বাংলাদেশ তার দেখা সবচেয়ে অতিথিপরায়ণ দেশ। ইতিমধ্যেই ২৮ টি দেশ ভ্রমণ করা কোনো ট্র্যাভেলারের কাছ থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতি একদম ফেলনা নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে মোটামুটি পরিচিত হয়েছেন জেসন। পহেলা ফাল্গুনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণচাঞ্চল্যময় পরিবেশ, হরেক রঙের শাড়ি এবং পাঞ্জাবি পরিহিত ছাত্রছাত্রীদের মুখরতা জেসনকে মুগ্ধ করেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবেশ জেসনকে নাড়া দিয়েছে। আবার একটি বাংলাদেশি বিয়ের অনুষ্ঠানের উৎসবমুখর পরিবেশ জেসনকে অভিভূত করেছে। এমন “কালারফুল” এবং “ফুল অফ লাইফ” ইভেন্টগুলোই ট্র্যাভেলারদের আকর্ষিত করে।
জেসনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে খাবার, অবস্থান, যাতায়াত ইত্যাদি ব্যায় পর্যটকদের জন্য সহনীয়। জেসনের মতে বাংলাদেশি দোকানদারেরা বিদেশি পর্যটক দেখে লুটে নিতে চায় না। তার মতে যারা বাজেট ট্র্যাভেলার, তাদের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ পছন্দ হতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, সে যেহেতু খরচগুলোকে পাউন্ডে কনভার্ট করে হিসাব করেছে তাই তার দৃষ্টিতে যেটা সস্তা, গড়পড়তা বাংলাদেশিদের নিকট তা সস্তা মনে নাও হতে পারে। বাংলাদেশে যারা জেসনকে আতিথ্য দিয়েছেন তারা সকলেই বিশেষভাবে ধন্যবাদ প্রাপ্য। তাদের আতিথ্য আর আন্তরিকতার কারণেই জেসন তার ভিডিওতে বলেছে “বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই আমার হৃদয় ছুঁয়েছে, বাংলাদেশ আমার দেখা সবচেয়ে অতিথিপরায়ণ দেশ”।
একটি সফল ট্যুর শেষে দারুণ সব স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে জেসন বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। তবে সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ফিরে আসার কথা জানাতে ভোলেননি। যা প্রমাণ করে, পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো সব কিছু আছে বাংলাদেশে। তারপরও কেনো বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশে আসছে না? জেসনের বাংলাদেশে করা ভিডিওগুলো দেখলে এই প্রশ্নের উত্তর খানিকটা মিলবে। বর্তমানে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগন্ডার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী পর্যটকেরা মুসলিম মেজরিটি দেশগুলোকে একটু বাঁকা চোখে দেখছে। নিরাপত্তাজনিত শঙ্কার কারণে পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় বাংলাদেশ থাকছে না। অথচ বাংলাদেশে দুইমাস অবস্থানকালীন জেসনের সাথে একটাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশ ভ্রমণের শেষ ভ্লগে জেসন বর্ণনা করেছেন এই দেশ পর্যটকদের জন্য কতটা নিরাপদ এবং একই সাথে বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিতও করেছেন। জেসনের ভ্লগ হয়তো আরো কিছু পর্যটককে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিত করবে, তবে বাংলাদেশের ইমেজ এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে মূলত আমাদেরকেই কাজ করতে হবে। সারা বিশ্বে একটি নিরাপদ এবং শান্তিকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইমেজ গঠনে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
আমাদের চিরাচরিত দাপ্তরিক জটিলতা পর্যটন শিল্পের বিকাশে আরেকটি বড় অন্তরায়। জেসনের বাংলাদেশ ভ্রমণের একমাত্র বাজে অভিজ্ঞতা ভিসা অফিসে ভিসা এক্সটেনশনের জন্য কাঠখড় পোড়ানো। জেসনের ভাষায় “টেরিবল ভিসা অফিস”। রাজধানী ঢাকাকে নিয়েও বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের মাঝে নেতিবাচক মনোভাব আছে। ঢাকা একই সাথে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং দুষিত শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে। সেই সাথে আছে অসহনীয় ট্র্যাফিক জ্যাম।
সব মিলিয়ে ঢাকা মোটেই পর্যটকদের জন্য আদর্শ শহর নয়। ঢাকার পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়, কিন্তু এমন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব যাতে পর্যটকেরা চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটে অবতরণ করতে পারে এবং সেখানেই ভিসা এবং অন্যান্য ফর্মালিটি সম্পন্ন করতে পারে। এতে করে তাদের ঢাকায় আসতে হবে না, এবং ঢাকা সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে না। যেহেতু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ রাস্তায় বিদেশিদের দেখতে অভ্যস্ত নয় তাই কোনো বিদেশিকে রাস্তায় দেখা গেলে ভিড় জমে যায়, অনেকেই শুধুমাত্র কৌতূহলবশত পিছু নেয়। জেসনকেও অনেকবার এমন পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে, এবং এক্ষেত্রে তিনি খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পর্যটকই এ ধরণের অযাচিত কৌতূহলে বিরক্ত হবে। এ ব্যাপারে সচেতনতা প্রয়োজন, অন্তত টুরিস্ট স্পটগুলোতে।
একজন নিরামিষভোজী হওয়ায় জেসনকে বাইরে খাবারের ক্ষেত্রে খানিকটা অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে, যেহেতু আমাদের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী রেস্টুরেন্টগুলোতে নিরামিষভোজীদের জন্য তেমন কোন অপশন থাকে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকেই নিরামিষভোজী হয়ে থাকেন, তাই পর্যটকদের সুবিধার্থে আমাদের টুরিস্ট স্পটগুলোর আশেপাশের রেস্টুরেন্টগুলোতে নিরামিষভোজীদের জন্য ব্যবস্থা রাখা উচিত।
এই সমস্যাগুলো অবশ্য নতুন কিছু নয়। জেসনের ভ্লগ আমাদের আবার নতুন করে সমস্যাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছে। অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের বিকাশে এগুলো নিয়ে কার্যকর এবং আন্তরিক পদক্ষেপ প্রয়োজন, এবং সেটা দ্রুতই প্রয়োজন। যদি তা না হয় তবে জেসনের মতো পর্যটকদের কালেভদ্রেই বাংলাদেশে দেখা যাবে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন