পতিতাবৃত্তি করলেই কেউ কাফের হয়ে যাবেন, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবেন- এই ধরণের কথা কি ইসলামে কোথাও বলা আছে? ইসলামে আত্মহত্যা হারাম, তাই বলে কি আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া হয় না?
দৌলতদিয়ায় পতিতাপল্লীতে যেসব যৌনকর্মীরা মারা যান, তাদের জানাজা পড়ানো হয় না, ইসলামিক রীতি মেনে কবরও দেয়া হয় না। ‘খারাপ পাড়ার মেয়ে’ বা ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত এই মানুষগুলো জীবিত অবস্থায় তো বিন্দুমাত্র সম্মান কোথাও পান না, মৃত্যুর পরেও মেলে না স্বীকৃতি। মারা গেলে এদের দেহটা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো, নইলে পুঁতে ফেলা হতো কোন ধর্মীয় রীতিনীতি না মেনেই।
বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই ভ্রান্ত নিয়মটা ভেঙেছিলেন গোয়ালন্দ থানার ওসি আশিকুর রহমান। একজন ইমামকে নিয়ে এসে তিনি হামিদা বেগম নামের এক যৌনকর্মীর জানাজার নামাজ পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই জানাজায় হাজির ছিলেন দুইশোর বেশি মানুষ, কূলখানিতে এসেছিলেন এর দ্বিগুণেরও বেশি লোকজন। দুই-তিন দিন আগে একটা খবর শুনে প্রচণ্ড ভালো লাগায় মন আচ্ছন্ন হয়েছিল, মনে হয়েছিল, ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে যে মানুষগুলো মৃত্যুর পরেও বর্বর আচরণের শিকার হতেন, তাদের ওপর সেই বর্বরতার অবসান হতে চলেছে বুঝি!
কিন্ত এটা তো বাংলাদেশ, এখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যা বরাবরই পাল্লায় ভারী। ভালোর চেয়ে মন্দের সংখ্যা বেশি, জোরও বেশি। আর তাই যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানোর ঘটনাটা নিয়েই ধর্মের অপব্যাখ্যা হাজির করে ফেলেছে স্থানীয়রা। যে মোস্তফা মাওলানা হামিদা বেগমের জানাজা পড়িয়েছিলেন, তাকেও একঘরে করে রাখা হয়েছে, নিত্য হুমকি-ধামকির শিকার হচ্ছেন তিনি। বিরক্ত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর কখনও যৌনকর্মীদের কারো মৃত্যু হলে তিনি জানাজা পড়াতে আসবেন না, এসব ঝামেলা নেয়ার মতো বয়স বা শক্তি কোনটাই তার নেই।
এলাকার লোকজন বলছে, যৌনকর্মীরা যেহেতু ইসলাম বহির্ভূত কাজ করেন, সেকারণে মৃত্যুর পরে তাদের ধর্মীর আনুষ্ঠানিকতার কোন প্রয়োজন নেই। তাদের মতে, পতিতালয়ে থাকে খারাপ মেয়েরা, সেখানে ধর্মের কোন জায়গা নেই। তারা ‘ভালো মানুষ’ হলে তো নিশ্চয়ই পতিতালয়ে থাকার দরকার হতো না। মোস্তফা মাওলানার ওপরেও তাদের ক্ষোভ, কেন তিনি এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা না বলে, কারো অনুমতি না নিয়ে পতিতার জানাজা পড়াতে গেলেন। এমন ‘ধর্মচ্যুত’ ইমামের পেছনে আর কখনও নামাজ না পড়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে গ্রামের মানুষ। মোস্তফা মাওলানা কেন আর কখনও যৌনকর্মীদের জানাজা না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা ওই এলাকার মানুষের ক্ষোভ দেখলেই বোঝা যায়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতগুলো মানুষের কেউই ইসলামের বিধি-বিধানটা শুনতে চাইলেন না, ধর্মের নামে ফতোয়া জারীর আগে একটু জানার চেষ্টা করলেন না যে ধর্ম কি বলছে এই ব্যাপারে। পতিতাবৃত্তির কাজটাকে কেউ শখ করে বেছে নেয় না, মনের খুশিতে কেউ এই পথে আসে না। একজন মানুষ যদি মুসলমান হয়ে থাকেন, তার জানাজা পড়ানো যাবে, এই কথা ইসলামে স্পষ্টভাবেই বলা আছে। হামিদা বেগমের কথাই ধরা যাক, তিনি কি শিরক করেছিলেন? ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন? যদি না করে থাকেন তাহলে কেন হামিদা বেগমের জানাজা নিয়ে এত জলঘোলা? তিনি পতিতা ছিলেন, এই কারণে?
পতিতাবৃত্তি হারাম কাজ, এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্ত হারাম কাজ করলেই কি মুসলমানের খাতা থেকে কারো নাম কাঁটা পড়ে যাবে? এমন কোন নির্দেশনা তো ইসলাম দেয়নি। পতিতাবৃত্তি করলেই কেউ কাফের হয়ে যাবেন, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবেন- এই ধরণের কথা কি ইসলামে কোথাও বলা আছে? ইসলামে আত্মহত্যা হারাম, তাই বলে কি আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া হয় না? পতিতার লাশ দাফন করা যদি হারাম হয়, তাহলে পতিতার কাছে যারা যায়, তাদের লাশ দাফনের ব্যাপারে কেন কেউ কোন ফতোয়া দেয় না? পতিতাবৃত্তি অপরাধ, কিন্ত পতিতার সঙ্গে রাত কাটানোটা ধর্মের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, দৌলতদিয়ার এই জায়গাটাতে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্যে কিন্ত ঠিকই পতিতাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয়। দুই ঈদ কিংবা অন্যান্য উপলক্ষ্যে, রমজান মাসে খতম তারাবীর নামে নিয়মিতই টাকা তোলা হয় পতিতাপল্লী থেকে। তখন যৌনকর্মীদের দেহব্যবসার টাকাগুলো হালাল হয়ে যায়, কারো কোন সমস্যা হয় না। শুধু যৌনকর্মী মারা গেলে তার জানাজার বেলায় ধর্ম এসে পড়ে, ফতোয়া জারী হয়, হালাল-হারামের আজগুবি হিসেব চলে আসে সামনে। অনেক বছর আগে লালন লিখেছিলেন- “গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়…” লালনের সেই কথাটা ২০২০ সালের বাংলাদেশেও নির্জলা সত্য।
ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার কোন প্যারামিটারে যদি মাপা হতো, সবার ওপরে বোধহয় বাঙালী মুসলমানেরা জায়গা করে নিতো। ধর্মকে যে যার খুশিমতো ব্যবহার করছে এখানে, নিয়ম-নীতি বানাচ্ছে। অথচ ধর্মগ্রন্থে কি বলা আছে, সেটা কেউ মানার চেষ্টা করছে না। মানবতার ধর্মটাকে যদি অমানবিক আচরণের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়, তাহলে যে আল্লাহ ও মহানবীকে অপমান করা হয়, সেটা কি এই বকধার্মিকেরা জানে?
এরপরে হয়তো দৌলতদিয়ায় আর কোন যৌনকর্মী মারা গেলে জানাজার নামাজ পড়াতে এগিয়ে আসবে না কেউ, সেধে উটকো ঝামেলায় পড়তে কেইবা চাইবে? যে মানুষগুলো প্রতারণার শিকার হয়ে, পেটের দায়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে এই পথে আসতে বাধ্য হয়েছে, তারা বেঁচে থাকতে তো বিন্দুমাত্র সম্মান বা স্বীকৃতি কোথাও পায় না, মৃত্যুর পরেও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাটুকু তাদের দিতে আমাদের আপত্তি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ অন্যায় করলে সেটার শাস্তি আল্লাহ তাআলা দেবেন, শেষ বিচারের দিন নিজের কৃতকর্মের হিসেব সে দেবে। কিন্ত তার আগে আমরাই কেন মানুষগুলোকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছি?
আরও পড়ুন- যৌনকর্মীদেরও রয়েছে জানাজার অধিকার!