জামিলুর রেজা চৌধুরী: একজন কিংবদন্তীর কথকতা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বিদেশের লোভনীয় চাকরি আর ক্যারিয়ার ছেড়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন, নিজ দেশের জন্য কিছু করবেন বলে। সারাটা কর্মজীবন তিনি দেশকে দিয়েই গেছেন, যমুনা সেতু থেকে পদ্মা সেতু- সর্বত্র লেগে আছে তার ছোঁয়া...
ফাইনাল পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কৃতিত্বের সাথে পাশ করা এক তরুণ গেলেন বুয়েটের নিজের বিভাগীয় প্রধানের সাথে দেখা করতে। সেই শিক্ষক তাকে দেখেই বললেন, এই জামিল, একজন টিচার আসেননি আজকে। তুমি ওর ক্লাসটা একটু নাও, থার্ড ইয়ারে চলে যাও। জামিল নামের সেই তরুণ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন, এসেছেন সালাম করে দোয়া নিতে, এ কি বিপদ জুটলো ঘাড়ে!
কিন্ত ভয় পেলেন না, দুরুদুরু বুকের কম্পন চেপে রেখে হেঁটে গেলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ারের ক্লাসের দিকে। তরুণটি তখন ভাবতে পারেনি, একদিন দেশের সবচেয়ে প্রথিতযশা শিক্ষকদের একজনে পরিণত হবে সে, দেশের জন্যে অপরিসীম অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তার নাম উচ্চারণ করা হবে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে। সেদিনের সেই সেই তরুণের নাম জামিলুর রেজা চৌধুরী।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করা জামিলুর রেজা চৌধুরী। যমুনা বহুমূখী সেতু থেকে হালের পদ্মা সেতু, সব জায়গাতেই তার ভূমিকা ছিল, তিনি অবদান রেখেছেন। সেই ষাটের দশকে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেই পরিচয়টা তার সঙ্গী ছিল। বুয়েট-ব্র্যাক হয়ে গত কয়েক বছর ধরে ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
গতকাল গভীর রাতে মাইল্ড স্ট্রোক করে মারা গেলেন মানুষটা, ৭৭ বছর বয়সে। সারাটা জীবন তিনি দেশের উপকার করেছেন, দেশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। যে দেশ তাকে জামিলুর রেজা চৌধুরী বানিয়েছে, সেই দেশের কাজে নিজেকে বরাবরই উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত স্থাপনার সঙ্গে তিনি যুক্ত থেকেছেন, নিজের মেধা দিয়ে অবদান রেখেছেন।
জন্ম নিয়েছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের সিলেটে, ১৯৪৩ সালে। ত্রিকালদর্শী এই মানুষটা ইংরেজ আমলের বাতাস গায়ে মেখেছেন, পাকিস্তান আমল দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মের পর তো দেশটাকে গড়ার কাজেই লেগে গেছেন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত, তাদের বাড়িটাকেই এলাকার লোকে ডাকতো ইঞ্জিনিয়ার বাড়ি। সেই বাড়ির সন্তান জামিলুর রেজা চৌধুরী যে ইঞ্জিনিয়ারই হবেন, তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না।
১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখনকার নাম ছিল আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ)। ১৯৬৩ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন, সেই গল্পটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। ১৯৬৪ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরী পাড়ি জমালেন যুক্তরাজ্যে। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করলেন। ১৯৬৮ সালে সেখানেই পিএইচডি শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘শিয়ার ওয়াল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং’।
চাইলে বিলেতেই থেকে যেতে পারতেন, মোটা অংকের বেতনে বিখ্যাত কোন কোম্পানীতে চাকরি করাটা তার মতো মানুষের জন্যে ডালভাত ব্যাপার ছিল। কিন্ত বিদেশে তিনি থাকতে চাইলেন না, দেশের জন্য কিছু করবেন, নিজের মেধা আর সামর্থ্যের সবটুকু দেশেই খরচ করবেন, এটাই ছিল তার ভাবনায়। তাই ফিরে এলেন। এই সিদ্ধান্ত নিতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা তখন অস্থিতিশীল, পরিবার চাইছিল না তিনি দেশে ফিরে আসুন। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলছিলেন সেই অস্থির সময়ের কথা-
“আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার অফার উপেক্ষা করে আমি দেশে ফিরে আবারও যোগ দিলাম বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে। কারণ আমার সব সময় মনে হতো, এ জীবনে যদি কিছু দিয়ে যেতে পারি, তা আমার মাতৃভূমিকেই দেব। বিশেষজ্ঞদের প্রবাসী হওয়ার ক্ষেত্রে একটা কথা বলা হয়, বাংলাদেশে কাজ করলে প্রফেশনাল স্যাটিসফেকশন আসে না। কিন্তু আমি বলি, বাংলাদেশে থেকে আমি যত ধরনের প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি; মনে হয় না, বিদেশে গেলে কেউ এ সুযোগ পেতেন।”
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রদের কাছে ছিলেন প্রিয়, জেআরসি স্যার নামে তাকে ডাকতো ছাত্ররা; বহির্বিশ্বেও ছিলেন ভীষণ সম্মানিত একজন। তাঁর গবেষণাপত্র বহু বছর পৃথিবীব্যাপী পড়ানো হয়। বহুতল ভবন তৈরিতে তাঁর থিসিস ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। ষাটের দশকেই বুয়েটের শিক্ষক থাকাকালে অনেকের মতবিরোধ উপেক্ষা করেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের জন্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কারণ পিএইচডি করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, ভবিষ্যতের দিনগুলোতে ডিজাইনের জন্যে কম্পিউটার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বুয়েটে তখন কেউই কম্পিউটার চালাতে পারতো না, তিনি নিজেই পড়াতে শুরু করলেন সাবজেক্টটা। ১৯৭৪ সালে, স্বাধীন দেশে বুয়েটে প্রথমবার কম্পিউটার কেনা হলো প্রায় এক কোটি টাকা খরচায়, সেটাও জামিলুর রেজা চৌধুরীর তত্ত্বাবধানেই।
যমুনা সেতু প্রকল্পে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এর আগে ১৯৭৭ সালে ভূমিকম্পরোধী ভবনের বিল্ডিং কোডের আউটলাইন নির্মিত হয়েছে তার হাতে। তার দেয়া আউটলাইন অনুসারেই বাংলাদেশের বড় বড় সব ভবন তৈরী হয়েছে, আকাশ ছুঁয়েছে সেসব ইমারত। দীর্ঘ কর্মজীবনে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছেন, কখনও কর্তব্য এড়িয়ে যাননি। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেই সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
তার মনটা ছিল আকাশের মতোই বিশাল, উদার। নিজের কর্মজীবন তো উৎসর্গ করেছেনই দেশের জন্যে, এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন জীবনভর। সিলেটে ৭ একর জায়গা জুড়ে একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরী করেছেন বাংলাদেশ ফিমেল অ্যাকাডেমি। অনাথ, দুস্থ, অবহেলিত মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা তার এ প্রতিষ্ঠান পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি বয়স। প্রথম শ্রেনী থেকে মাস্টার্স, কৃষি থেকে আইটি, সব ধরণের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে এখানে, একদম বিনে পয়সায়। রয়েছে থাকা খাওয়ার সুবিধাও। প্রতি বছর একশোর বেশি অনাথ মেয়ে আশ্রয় পায় এই একাডেমীতে। মা-বাবা হারা, আত্মীয় স্বজন ছাড়া, রাস্তায় বেড়ে ওঠা অনাথ শিশুদের ঠাই হয় এখানে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বেশ কয়েকবারই বুয়েটসহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার বাসনা তার ছিল না। তিনি নিজেই বলতেন, "পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলে রাজনৈতিক চাপ আসবে। ছাত্ররা আন্দোলন করবে, শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধটা এখন প্রকট। রাতের বেলাও সতর্ক থাকতে হবে, ক্যাম্পাসে কোথায়, কী হচ্ছে। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তিতে ঘুমাতে চাই।"
রাজনৈতিক মতাদর্শ হয়তো ছিল, কিন্ত সেটাকে কখনও প্রকাশ্যে আনেননি জামিলুর রেজা চৌধুরী। আপাদমস্তক ভদ্রলোক এই মানুষটাকে দলমত নির্বিশেষে সম্মান করতো সবাই। কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সরকার যখন কোণঠাসা অবস্থায়, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের খরচেই পদ্মা সেতু বানাবেন। সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা পরীক্ষার জন্য তিনি ডেকে নিয়েছেন বরেণ্য এই শিক্ষককেই।
প্রধানমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনি এই কাজের তদারকি করতে পারবেন কি?’ তিনি বলেছিলেন, ‘ডিজাইন যেহেতু হয়ে গেছে সুপারভিশন-এর কাজটা আমরা করতে পারব। মোট পাঁচটি প্রজেক্টের মধ্যে বড় দুটি বাদ দিয়ে অন্তত ছোট তিনটির কাজ আপনি শুরু করতে পারেন। নিজস্ব অর্থায়নেই হোক। আমরা তদারকি করব। অসুবিধা হবে না।’ গভর্ণর আতিউর রহমানের দেয়া সাহস আর জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাছ থেকে পাওয়া ভরসার জোরেই শেখ হাসিনা পা বাড়িয়েছেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানানোর পথে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে এই দেশে সূর্যসন্তান জন্ম নিয়েছেন খুব কম। সেই অল্পসংখ্যক মানুষদের একজন ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ছোট্ট একটা লেখায় তার সুবিশাল কর্মজীবনকে ধারণ করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। ২০২০ সালটা আমাদের জন্য হারিয়ে ফেলার বছর। এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে যাত্রা করেছেন জামিলুর রেজা চৌধুরীও। আমাদের কিংবদন্তী, আমাদের সুপারহিরোরা হারিয়ে যাচ্ছেন একে একে। বিদায় নিচ্ছেন তারা, রেখে যাচ্ছেন নিজেদের কীর্তিগাঁথা। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন কি জামিলুর রেজা চৌধুরীর অবদানকে অস্বীকার করতে পারবে কেউ? সেটা তো সম্ভব নয়…