অক্টোবর ট্র্যাজেডি: পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল জগন্নাথ হলে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
রাত আটটার খবরের পর নাটক দেখার জন্য জগন্নাথ হলের টিভি রুমে জড়ো হয়েছিল ছাত্ররা। কেউ জানতো না, খানিক পরেই নেমে আসবে মহা দুর্যোগ, মুহূর্তের মধ্যে সলীল সমাধি হবে ৪০টি প্রাণের!
অনেক সময় প্রকৃতি নাকি আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস দেয়। আমরা হয়তো বুঝতে পারি, হয়তো পারি না। আজ থেকে পয়ত্রিশ বছর আগের সেদিনেও প্রকৃতি কিন্তু সেরকম পূর্বাভাস দিয়েছিলো। বিকেল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ঈশানকোণে মেঘ। কী যেন একটা আসতে চলেছে। ভয়ঙ্কর কী যেন একটা। আকাশের সফেদ বুকে কেউ যেন ডলে দিয়েছে দোয়াতের কালি। কালো মেঘ ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে ভয়াল শ্বাপদের মতন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছেলেরা সেদিন খুব বেশি দূর যায় নি কেউ। কারো টিউশনি, কারো গুলতানি, কারো বই নিয়ে আদিখ্যেতা... সবাই যার যার ব্যস্ততা নিয়ে ছিলো কাছেপিঠেই। উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক হচ্ছে রাজনীতি নিয়ে, খেলা নিয়ে, অর্থনীতি নিয়েও। সন্ধ্যার পর থেকে ঝোড়ো বাতাস একটু বাড়লো। বৃষ্টির তোড়ও। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত মানুষগুলো জড়ো হলো হলের চাতালে। সন্ধ্যার পর থেকেই খিদে চাগিয়ে উঠেছিলো সবার। ডাইনিং এ খেয়ে দেয়ে সবাই তাই টিভি রুমে একত্রিত হয়েছে। মানুষ সেখানে কত হবে! আন্দাজ দেড়শো দুইশো।তবে অনেকের দাবী, সে সংখ্যা তিনশো বা চারশো! সবার কথাবার্তায় সেখানে কান পাতা দায়। টিভিতে তখন একটাই চ্যানেল- বিটিভি। বিটিভির রাত আটটার খবর থেকে জানা গেলো- বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ চলছে। সে কারণেই ঢাকার এই ঝোড়ো বাতাস আর ভারী বৃষ্টিপাত।
আটটার খবর শেষ হলো। বিটিভি'র সে সময়ের বিখ্যাত নাটক 'শুকতারা' শুরু হবে একটু পর। সবাই আস্তে আস্তে টিভির সামনে জমতে শুরু করেছে। এই নাটক সবারই বেশ পছন্দ। নাটক শুরু হলো। পাঁচ মিনিটও যায়নি, হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। আদতে আকাশ না ভেঙ্গে পড়লেও যেটা হলো, টিভিরুমের ছাদ ধ্বসে পড়লো সবার উপরে। বিকট শব্দ আর পলেস্তরা খসা বাতাস গ্রাস করলো সব, ক্ষণিকের জন্যে। সে বাতাস ছাপিয়ে কিছু পরেই ভেসে এলো মানুষের আহাজারি, আর্তনাদ, ভয়ার্ত কন্ঠস্বর। এক লহমায় মারা গেলেন ৩৪ জন মানুষ। আহতদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হলো, শতাধিক আহত হলেন। হাসপাতালে যাদের নেওয়া হলো, তাদের মধ্যে মারা গেলেন আরো পাঁচজন। টিভি রুমের পুরোটা জুড়েই থকথকে রক্ত, মগজ, মানুষের লাশ, ইট-বালু-সিমেন্ট।
জানা গেলো, এই জরাজীর্ণ টিভি রুম একসময়ে ছিলো 'পরিষদ ভবন' বা 'অ্যাসেম্বলি হল।' একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই অডিটোরিয়ামটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিষদ ভবন বা সংসদ ভবন ছিল, তাই এটিকে বলা হতো অ্যাসেম্বলি হল বা পরিষদ ভবন। পরে নতুন পরিষদ ভবন গঠন করা হয় এবং এই মেয়াদোত্তীর্ণ ভবনটিকে দিয়ে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। জগন্নাথ হলের টিভি রুম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই পুরনো ভবনটিকে সংস্কার করে নি আর। এই ভবনের ছাদ এমনিতেই নাজুক অবস্থায় ছিলো। ঘটনার দিনে সারাদিন ধরে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় তাই ছাদ দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।
এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো দেশ। ভেঙ্গে ফেলা হয় পুরো ভবন। সে জায়গায় নির্মিত হয় 'অক্টোবর স্মৃতি ভবন' নামে জগন্নাথ হলের নতুন একটি ছাত্রাবাস। এ ঘটনার পরের বছর থেকেই ১৫ই অক্টোবর পালিত হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস' হিসেবে।
এ ঘটনা শুধু যে দুর্ঘটনা, তা বললে ভুল হবে। প্রশাসনের উদাসীনতাকেও আনতে হবে সামনে। এরকম শত বছরের পুরোনো একটি ভবন'কে কোনোরকম সংস্কার ছাড়াই ছাত্রদের ব্যবহার করার জন্যে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে ঠিক কতটুকু যুক্তিবোধের ছাপ ছিলো, তা নিয়েও প্রশ্ন করা যায়। বাংলাদেশে এখনও অজস্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অগুনতি ভবন আছে, যেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে অনেক বছর আগেই। অথচ প্রশাসনের সেদিকে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। আরেকটি 'অক্টোবর ট্রাজেডি' ঘটলে তাদের হুশ ফিরবে কী না, সে তথ্যও নেই কারো কাছে। প্রশ্ন থেকে যায় সেখানেও।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন