'সারা পৃথিবীতে শুধু তিনজন মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে হত্যাকারীর সাথে দেখা করে ঠাণ্ডা মাথায় আলাপ করার সুযোগ পেয়েছে! আমি কিভাবে এই বিরল অভিজ্ঞতাটা না নিয়ে থাকতে পারি? আমি তো লাকি মানুষ!'
মৌলবাদীরা ব্লগার কায়দায় যেদিন জাফর স্যারকে কোপালো সেই দিনটা ছিল ২০১৮ সালের ৩ মার্চ। আমি আর সমুদ্র সেই দিনগুলোতে নিয়মিত সিএমএইচ-এর আশেপাশে ঘুরোঘুরি করতাম। স্যারের সাথে দেখা হবার কোন সুযোগ ছিল না।
সেই বছর স্যারের সাথে দেখা হয় নাই আর। দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালের জন্মদিনের দিন, অর্থাৎ আজকের দিনে। স্যারের বাসায় সেদিন বেশ আয়োজন। সব আত্মীয়-স্বজনেরা এসেছেন। স্যার এককোণায় চুপচাপ বসে আছেন। আমিও গিয়ে স্বভাবসুলভ মাটিতে পায়ের কাছে বসে পড়লাম। শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিলাম। লক্ষ্য করে দেখলাম উনি বাম হাতের একটা আঙুলের ওপর অন্য হাতটা বারবার বোলাচ্ছেন। আমি বুঝলাম এই আঙুলের ওপরেই ছুরির আঘাতটা পড়েছিল। আমার আর জিজ্ঞাসা করতে হল না। স্যার নিজে থেকেই বললেন, এই আঙ্গুলটা থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল। একটা রগ কাটা পড়েছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার কোন সমস্যা হয় নাকি। স্যার বললেন শীতের মধ্যে একটু সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ করে মাঝরাতে ব্যাথা করে। হাত বন্ধ করতে পারি না। এমনি কোন সমস্যা নাই।
স্যার এই কথা বলতে বলতেই আমরা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম স্যার আপনি এমনভাবে বর্বণা করতেসেন যেন আপনার কোন রোগ হইসে। আপনি অসুস্থ এবং সুস্থ হয়ে যাবেন কিছুদিন পরে। কিন্তু ঘটনা তো তা না। আপনাকে বিক্ষত করা হইসে। আপনার কি রাগ হয় না স্যার?
মৃদু গলায় বললেন 'কেন রাগ হবে কেন? তুমি তো জানো না, আমি একটা কাজ করেছি বুঝেছো। আমি তো ঐ ছেলেটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম!'
চোখ কপালে উঠলো। আমি মোটামুটি একটা চিৎকার দিয়েই বললাম! কি বলতেসেন স্যার! (পরে অবশ্য এই গল্প স্যার সাস্টের একটা প্রোগ্রামে বলেছিলেন)
স্যার বললেন চুপচাপ শোন, তোমাদের ম্যাডাম এখনো জানে না। জানলে আমার খবর আছে!
আমার খুব রাগ হল, 'আপনি কি পাগল!'
স্যার খুব মজার গল্প বলতেসেন এমন সুরে বললেন, 'সারা পৃথিবীতে শুধু তিনজন মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে হত্যাকারীর সাথে দেখা করে ঠাণ্ডা মাথায় আলাপ করার সুযোগ পেয়েছে! আমি কিভাবে এই বিরল অভিজ্ঞতাটা না নিয়ে থাকতে পারি? আমি তো লাকি মানুষ!'
এরপর একটা কৌতুক বলার মত করে পুরো গল্পটা স্যার বললেন। কিভাবে সেই ছেলে স্যারের কাছে বিচার দিল যে জেলখানায় খাবার ভালো না। কিভাবে স্যার ছেলেটাকে ছাড়া পাওয়ার পর তার সাথে গল্প করতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। কিভাবে স্যার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন 'ভূতের বাচ্চা সোলায়মান' বইটা ছেলেটা পড়েছে কি-না। ছেলেটার জবাব ছিল "আগে পড়ি নাই, তবে এখানে আসার পর পুলিশ পড়াইসে'। স্যার জিজ্ঞাসা করছিলেন এই বইতে ধর্ম বিরোধী কিছু আছে কি না। ছেলেটা উত্তরে বলেছিল 'না'। স্যার তখন জানতে চাইলেন তাহলে তাকে মারার চেষ্টা করাটা উচিত হয়েছিল কি-না? ছেলেটা একেবারে নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয়, 'এখানে না লিখলেও নিশ্চয়ই অন্য কোথাও লিখসেন!'
আমি পুরো গল্পের ভেতর কোন কৌতুক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি প্রচণ্ড রাগে ধমকের সুরে বললাম,
'স্যার আপনি কি জানেন না এই ছেলেটা আবার আসবে? এই ছেলের মত এক লক্ষ ছেলে একটা সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। আপনাকে কেন এখনো প্রতিটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে? আপনি কেন সাবধান হচ্ছেন না?'
এবার আবেগের বাঁধ ভেঙে গেলো।
স্যার শিশুদের মত কেঁদে ফেললেন,
'আমি কি জানি না...? তোমরা আমার জন্মদিনে কি শুরু করলা... আমি যতদিন বাঁচবো ছেলেমেয়েদের কাছে আমাকে যেতে হবে না...? মেলায় যেতে হবে না...? কি বল তুমি এসব...?'
আমিও কেঁদে ফেললাম। উপস্থিত সবার চোখ আদ্র হয়ে আসলো।
কৈশোরে এই লোকটার লেখা পড়ে পড়ে দেশকে ভালোবাসতে শিখেছি আমরা। ওনার সরাসরি ছাত্র না হতে পারলেও তাকে পড়ে পড়ে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম। তার দেখানো পথে, তার যুদ্ধে নিজের সবটা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিলাম।
একলব্য তাঁর অদেখা গুরুকে নিজের বুড়ো আঙুল কেটে দিতে দ্বিধা করেনি। আর আমার চোখের দেখা গুরুর বিপদের দিনে আমি হাসপাতালের বাউন্ডারির বাইরে বসে মাতম ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি।
আমি আমার সেই পরম ভালোবাসার মানুষটিকে কাঁদিয়েছি... খারাপ লাগে... মনে পড়লে খারাপ লাগে...