জ্যাকসন হাইটস- আমেরিকার বুকে বাংলাদেশীদের দাপুটে এক ঠিকানা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আপনি যদি জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ নাম্বার স্ট্রিটে ঢুকে পড়েন, ক্ষণিকের জন্য আপনার বিভ্রম হতেই পারে। এই সড়কটা পুরোটাই বাংলাদেশিদের দখলে। এখানকার ভবন, স্থাপনা, দোকানপাটের অনেকগুলোই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে চলে...
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস। এই এলাকার ৭৩-৭৪ নাম্বার স্ট্রিটে গেলে একটু অবাক হতে হয়। হাজার হাজার মাইল দূরের একটি রাষ্ট্রের বুকে একটা এলাকায় বাংলার এমন দাপট ভাবা যায় না। এখানকার দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, স্কুল সবর্ত্রই যেন বাংলার আধিপত্য। দোকানগুলোতে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড দেখে মনেই হবে না সুদূর কোনো অঞ্চলে আপনি আছেন৷ এ যেন চিরচেনা বাংলাদেশের কোনো শহরই যেন নেমে গেছে নিউইয়র্কের বুকে।
আপনি যদি জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ নাম্বার স্ট্রিটে ঢুকে পড়েন, ক্ষণিকের জন্য আপনার বিভ্রম হতেই পারে। এই সড়কটা পুরোটাই বাংলাদেশিদের দখলে। এখানকার ভবন, স্থাপনা, দোকানপাটের অনেকগুলোই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে চলে। এই স্ট্রিটের পাশাপাশি ৭৪ নাম্বার স্ট্রিটের কিছু অংশ, ৩৭ নাম্বার এভিনিউর অনেকটা জুড়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। ১৯৯১ সালে সম্ভবত প্রথম এই জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি মালিকানার দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়। মেঘনা বাজার এন্ড হালাল মিট নামক দোকানটি যেটি এখনো আছে, যা কিনা ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর কত সময় পেরিয়ে গেল, দিনে দিনে বাংলাদেশিদের এক প্রিয় জায়গা হয়ে উঠলো এই এলাকাটি।
মেঘনা সুপার শপের মালিক আবদুর রউফ প্রথম আলোকে একবার গল্প শুনিয়েছিলেন কীভাবে জ্যাকসন হাইটসে তিনি ব্যবসা শুরুর সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন,
"আমি যখন ১৯৯১ সালে জ্যাকসন হাইটসে মেঘনা গ্রোসারি করি তখন এই এলাকায় ভারতীয় ও চায়নিজদের প্রাধান্য ছিল বেশি। এখনকার মেঘনা গ্রোসারির জায়গায় দানাঘর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এই বিশাল পরিসর যখন ভাড়া নিয়েছিলাম তখন অনেকেই “আমি বড় ঝুঁকি নিয়েছি” বলে কথা বলেছিলেন। এই ঝুঁকিটা নিতে পেরেছিলাম। অ্যাস্টোরিয়াতে আমি ১৯৮৩ সাল থেকেই ব্যবসা করে আসছিলাম। তো, জ্যাকসন হাইটসে আমরা একটু আধটু বাংলাদেশি ও আমাদের সাউথ এশিয়ান পণ্য ওঠাতে শুরু করি। ওটা ছিল মূলত একটি ছোটখাটো সুপার শপ। সেই শপে ২-১০ করে যাতায়াত শুরু করলেন। পরে ৭৩ স্ট্রিটে প্রয়াত সাঈদ মান্নান ভাই খুললেন মান্নান গ্রোসারি। এর পরেরটা তো আপনারা দেখছেন!"
জ্যাকসন হাইটসে ডাইভার্সিটি প্লাজার কাছে একটা রেস্টুরেন্ট আছে আবু নোমান নামক এক বাঙ্গালি ভদ্রলোকের। তিনি স্বচক্ষে জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশিদের উত্থান দেখেছেন। তার ভাষায়, "মেঘনার আগে ছোট আকারে বাংলা বাজার নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল, সেখানে মূলত ভিডিও ক্যাসেট, কিছু চাল, ডাল পাওয়া যেত। কিন্তু এরপর, অ্যাস্টোরিয়ায় বেশি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ওই সময় জ্যাকসন হাইটসে মেঘনা গ্রোসারি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে, মান্নান সাহেব ১৯৯৬ সালে জ্যাকসন হাইটসে একটি হালাল মিট এবং ছোট আকারে গ্রোসারির দোকান দেন। এরপর সেখানে মানুষের যাতায়াত বাড়তে থাকে। এভাবে আস্তে আস্তে বাংলাদেশিরা আসতে শুরু করেন জ্যাকসন হাইটসে।
আমি যখন ২০০৪ সালে জ্যাকসন হাইটসে ইত্যাদির শোরুম খুলি, তখন মানুষ ছিল সব মিলিয়ে হয়তো ৫০ হাজার। এখন তো ১০ লাখ মানুষ হবে কমপক্ষে। এই বিশালসংখ্যক মানুষের চাহিদাও তো বিশাল, সে কারণেই প্রতিদিন বাড়ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এখন শুধু দোকান ভাড়াই নিচ্ছেন না বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। নিজস্ব প্রপার্টিজ কিনছেন। যেমন বাংলাদেশ প্লাজা এবং এখনকার আপনা বাজার ও সবজি মন্ডি ভবনের মালিক বাংলাদেশি। আমি যে, বেলাজিনো করেছি সেটারও মালিক একজন বাংলাদেশি। সব মিলিয়ে এখানে আমাদের আধিপত্য বাড়ছে।"
জ্যাকসন হাইটস সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প শোনা যায় সেখানকার বসবাসকারী মানুষদের কাছ থেকে। এই যেমন একটা মজার কথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ নাকি জ্যাকসন হাইটসকে নাকি নিউইয়র্কের গুলিস্থানও বলে থাকে। ছুটির দিনে জ্যাকসন হাইটসের অবস্থা কোনো অংশে ঢাকার জনপ্রিয় ব্যস্ততম সড়কের চেয়ে কম না। প্রচন্ড ভীড় হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, শুক্রবারের দিনটায় কি প্রচন্ড ভীড় হয়। প্রচুর গাড়ি এসে জমে, ভাসমান হকার বসে। হাঁটার জায়গা থাকে না। জ্যাকসন হাইটসেও ছুটির দিনে এমন হয়। রাস্তায় পার্কিং করার জায়গায় টান পড়ে। ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ হয়ে যায়। ফুটপাতে আমাদের দেশের মতো হরেক পদের দোকান বসে।
এই শহরে এসে আপনার নিজেকে খুব বেশি অচেনা মনে নাও হতে পারে। কারণ, এখানে বাংলা শুনতে পাবেন। বাংলায় লেখা টুলেটের বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। মিষ্টি খেতে মন চাইলে বাংলাদেশি মিষ্টির দোকানও আছে এখানে। জ্যাকসন হাইটস অনেকটা আমেরিকায় বাঙ্গালিদের রাজধানীর মতো। ঈদে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালি অভিবাসীরা নাকি জ্যাকসন হাইটসে চলে আসে, সব বাঙ্গালি মিলে ঈদ উদযাপন করার লক্ষ্যে। এইদিকে মেয়েরা হাতে মেহেদী লাগায়। ঈদের কেনাকাটায় ভিন্ন আমেজ দেখা যায়।
আবার গরমের সিজনে সেখানে বাংলাদেশি ফলের মেলা বসে যায়। এই সময়ে সেখানে গেলে কেউ আপনাকে আম দিয়ে আপ্যায়ন করে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই! আরেকটা দারুণ ব্যাপার হলো, হাজার মাইল দূরে বসেও বাংলাদেশকে জ্যাকসন হাইটসের প্রবাসীরা কখনো ভুলে যায় না। বরং, সেখানেও দেশ সচেতন মানুষ আছেন যাদেরকে দেশের বিভিন্ন ঘটনা ভীষণভাবে আলোড়িত করে।
এইতো ২০১৩ সালে যখন শাহবাগ উত্তাল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে, সেই ঢেউ লেগেছিল জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও। জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত সচেতন মানুষরা শাহবাগের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে সেখান সমাবেশও করেছিল! ‘ফাসি চাই, ফাঁসি চাই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসী চাই’, ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল জ্যাকসন হাইটস।
এই হলো জ্যাকসন হাইটসের গল্প, যেখানে বাংলা আছে, বাঙ্গালিরা আছে, আছে বাংলাদেশি স্বাদ। এখানকার প্রবাসীরা ভাল থাকুক, শান্তিপূর্ণ হোক তাদের জীবন এটাই প্রত্যাশা রাখি। নিউইয়র্কের বুকে বাংলার এমন দাপুটে ঠিকানা টিকে থাকুক আরো অনেকযুগ!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন