জেসিন্দা আরদার্ন: কোমল হৃদয়ের এক প্রধানমন্ত্রী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

নিউজিল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিনি, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জঙ্গী হামলার পরে এই ভদ্রমহিলা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেভাবে আন্তরিকতা আর দরদ দিয়ে তিনি আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পুরো জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য।
জেসিন্দা কেট লরেল আর্দার্ন- নামটা চেনা চেনা ঠেকছে? নামটা মনে রাখা দরকার, বিসিএসের প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় এই প্রশ্নটা আসতেই পারে! নামের মাঝের দুটো শব্দ বাদ দিয়ে দিন এবার, জেসিন্দা আর্দার্ন, তাকে তো চেনেন? নিউজিল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিনি, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জঙ্গী হামলার পরে এই ভদ্রমহিলা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেভাবে আন্তরিকতা আর দরদ দিয়ে তিনি আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পুরো জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য।
জেসিন্দা আর্দার্নকে নিয়ে শুধু বাংলাদেশ বা মুসলিম প্রধান দেশগুলোতেই যে আলোচনা হচ্ছে, এমনটা নয়। নিজের কাজের সুবাদে সারাবিশ্বেরই নজর কেড়ে নিয়েছেন তিনি। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জঙ্গী হামলার আগে জেসিন্দার নামটাও জানতাম না, হামলার দিন দুপুরেই হঠাৎ একটা ভিডিওতে দেখলাম তাকে। স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি বলে চলেছেন, 'টেরোরিস্টকে টেরোরিস্টই বলতে হবে! যে মানুষগুলো মারা গিয়েছেন, হয়তো তারা ইমিগ্র্যান্ট ছিলেন, অন্য দেশ থেকে এসেছিলেন, কিন্ত তারা সবকিছু ছেড়ে নিউজিল্যান্ডকেই আপন করে নিতে চেয়েছিলেন, এই দেশটাকে নিরাপদ ভেবেছিলেন। সেই নিরাপত্তাটা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি...' একটা বাক্য তিনি বারবার উচ্চারণ করছিলেন, 'they are us!' কথা বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসছিল। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘটনাটা তাকে কতটা আঘাত দিয়েছে, সেটা তার মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছিল।
সেই হামলার পরে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। হামলাকারী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে, সেই দুর্যোগের পরপরপই যোগ্য নেতার মতোই পুরো জাতিকে এক সুতোয় বাঁধার কাজটা সুনিপুণভাবে করে চলেছেন জেসিন্দা। নিউজিল্যান্ডের আতঙ্কগ্রস্ত মুসলিম কমিউনিটিকে নিজে গিয়ে স্বান্তনা দিয়ে এসেছেন তিনি, তাদের আশ্বাস দিয়েছেন, একজন নেটিভ শ্বেতাঙ্গের চেয়ে আলাদাভাবে তাদেরকে দেখা হবে না। নিহতদের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় হাজির হয়েছেন মাথায় কাপড় দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানদের সঙ্গেই আছেন তিনি এবং পুরো দেশ।

পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তৃতা শুরু করেছেন 'সালাম আলেকুম' বলে, দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের আইন সর্বশক্তি দিয়ে দোষীর বিচার করবে। জেসিন্দা আর্দার্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতটা ভালো করবেন, সেটা সময় বলে দেবে। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর দুই বছর পেরিয়েছে কেবল। তবে জেসিন্দা যে অসম্ভব ভালো মনের একজন মানুষ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নেতৃত্বের চমৎকার গুণাবলীও বিদ্যমান তার মধ্যে। একারণেই ২০১৭ সালে নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগতে থাকা নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টি তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে মনোনয়ন দিয়ে দু'বার ভাবেনি। অথচ তখন তার বয়স মাত্র ৩৭!
২০১৭ সালটা অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় কেটেছে জেসিন্দার। মার্চে লেবার পার্টির ডেপুটি চিফ হলেন, আগস্টে পুরো দলের দায়িত্বই এসে পড়লো তার কাঁধে। তারও আগে পার্লামেন্টের স্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। দু'মাস পরে নির্বাচন, তার আগে দলের বেসামাল অবস্থা- সেখান থেকে বিরুদ্ধস্রোতে তরী বেয়ে দলকে সম্মানজনক একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন তিনি, প্রচারণা চালালেন শহরে শহরে। দারুণ একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলো তার, বিশ্লেষকেরা সেটাকে বর্ণনা করেছিলেন 'জেসিন্দাম্যানিয়া' নামে।

ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, ১২০ টি আসনের মধ্যে জেসিন্দার দল লেবার পার্টি পেয়েছে ৪৬ টি আসন, যেটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সরকার গঠনের জন্যে সেটা যথেষ্ট ছিল না। পরে কোয়ালিশন গড়ে ক্ষমতায় এলো লেবার পার্টি, জেসিন্দা বসলেন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে। সেইসঙ্গে একটা রেকর্ডও হয়ে গেল, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়েসী প্রাইম।মিনিস্টার এখন তিনিই। বিশ্বের নারী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যেও তিনিই সর্বকণিষ্ঠ।
১৯৮০ সালে জন্ম জেসিন্দার, বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, আর মা কাজ করতেন একটা স্কুলের ক্যাটারিং সার্ভিসে। ছোটবেলা থেকেই সংগঠনপ্রীতি ছিল জেসিন্দার, নেতৃত্বের গুণটাও সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াইকাটো থেকে ২০০১ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরে রাজনৈতিক গবেষক হিসেবে যোগ দিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের অফিসে। মাঝে একবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের অফিসে পলিসি অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। এরপরে দেশে ফিরলেন, ততদিনে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে গিয়েছেন তিনি, তার খালা ছিলেন নিউজিল্যান্ড কেবার পার্টির নেত্রী, সেই দলেই যোগ দিয়েছিলেন জেসিন্দা। ২০০৮ সালে ছায়া সরকারের এমপি নির্বাচিত হলেন মাউন্ট অ্যালবার্ট থেকে, তখন তার বয়স মাত্র ২৮! সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ অবশ্য পাননি তখনও। সেই সুযোগটা এলো বছর নয়েক পরে।

জেসিন্দা আর্দার্ন এখন বিশ্বের সর্বকণিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রীদের একজন, নিউজিল্যান্ডে তার দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে ধীরে ধীরে, আগামী নির্বাচনেও তার দলই ক্ষমতায় থাকবে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। মানুষ কেন তাকে পছন্দ করবে, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না, জঙ্গী হামলার পরে তার কথা, তার কাজ দেখলেই মানুষ তাকে ভালোবাসতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রীর খোলস ভেঙে তিনি সাধারণের কাতারে নেমে এসে জড়িয়ে ধরছেন ক্ষতিগ্রস্থদের, একদিকে তাদের স্বান্তনা দিচ্ছেন, আবার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করছেন অপরাধী শাস্তি পাবেই। কোমলতা আর কঠোরতার অসাধারণ এই মিশ্রণটাই জেসিন্দাকে অনন্য করে তুলেছে।
খুনীর ব্যাপারে জেসিন্দা বারবার বলেছেন, 'ওই লোকটা জঙ্গী, সে সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, খুনের নেশায় মত্ত একজন উন্মাদ। ওর নামটাও আমি আর মুখে আনতে চাই না, বরং আপনারা তাদের কথা বলুন, যারা নিহত হয়েছেন। তাদের স্মরণ করুন, যারা প্রাণ দিয়েছেন।' ইতিহাস এই পঞ্চাশজন হতভাগ্য মানুষকে মনে রাখবে কিনা জানিনা, তবে বিপর্যয়ের মূহুর্তে জেসিন্দা আর্দার্নের এই অসামান্য ভূমিকার কথা আমরা ভুলবো না, একজন কোমল হৃদয়ের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে তার দেশের আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই আমাদের মনে থাকবে...