আত্মহত্যা করতে চাওয়া মানুষটাই হয়েছেন পৃথিবীর একমাত্র বিলিওনিয়ার লেখক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

কোলে ছোট্ট মেয়ে, উপার্জন নেই, সরকারী ভাতাটাই কেবল মা-মেয়ের সম্বল। অনিশ্চয়তা আর হতাশায় কাটছিল দিনগুলো। এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন একটা পর্যায়ে!
এডিনবার্গ, স্কটল্যান্ড। সাল ১৯৯৬। ভদ্রমহিলার বয়স ত্রিশের কোঠায়। বেশ সুন্দরী দেখতে। বসে আছেন মাঝারী সাইজের একটা ঘরে। চেহারায় বিষণ্ণ একটা ভাব ফুটে আছে তাঁর। থাকাটাই স্বাভাবিক। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। ঘরে ছোট মেয়েটা আছে। চাকরী নেই। কাজের মধ্যে লেখালেখিটাই মোটামুটি পারেন। সেটাকেই সম্বল করবেন ভেবেছিলেন। কিন্ত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এক বছর হলো দুটো বই লিখেছেন, কিন্ত কেউ ছাপাতে রাজী হচ্ছে না সেগুলো। কাহিনীটাই নাকি উদ্ভট।
শিশুতোষ উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, একটা ক্যাফেতে বসে প্লটটা মাথায় খেলে গিয়েছিলো তাঁর। সেটার নাম “The Cuckoo's Calling”... অন্য বইটা একটা ছেলেকে নিয়ে, কল্পকাহিনী ঘরানার লেখা। এই প্রকাশক বেশ কিছুদিন আগে এক এজেন্টের মাধ্যমে পান্ডুলিপি দুটো নিয়েছিলেন। আজ ফেরত দেয়ার কথা। ভদ্রমহিলার বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা যথেষ্ট সয়েছেন তিনি গত এক বছরে। কিন্ত এবার মন বলছে কিছু একটা হবে!
ধরা যাক এই মহিলার নাম জোয়ানে। থাক, ধরা টরার দরকার নেই, এটাই তাঁর আসল নামের একটা অংশ। পুরো নামে পরে আসছি, আগে আরেকটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। বছর কয়েক পেছনে ফিরে যাই। পর্তুগীজ স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জোয়ানে ফিরে এলেন স্বদেশে, ইংল্যান্ডে। ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ছিল তাঁর, সেক্রেটারী হবার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। কিন্ত মন পড়ে থাকতো লেখালেখিতে। তাই চাকরী ছেড়ে দিলেন। শুরু হলো কষ্টের অধ্যায়। কোলে ছোট্ট মেয়ে, উপার্জন নেই, সরকারী ভাতাটাই কেবল মা-মেয়ের সম্বল। ইংল্যান্ডে তখন বেকারত্ব সমস্যা প্রকট। তীব্র অনিশ্চয়তা আর হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন জোয়ানে। এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন একটা পর্যায়ে। শুধু মেয়েটার কথা ভেবে সেই অন্ধকার পথে পা বাড়াননি, অনিশ্চয়তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন।
এডিনবরার এক ক্যাফেতে কাজ করেছিলেন কিছু দিন। সেখানে বসেই একটা উপন্যাস লেখা শুরু করলেন। লেখার সময়টা মোটেও নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। মেয়ে তখন একদম ছোট, সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয়। তার ওপর ক্যাফের কাজের চাপ- সবদিক সামলে চালিয়ে গেলেন লেখা। ১৯৯৫ সালে সেটা শেষও হলো। কিন্ত ছাপাবে কে? যাকেই পান্ডুলিপি পড়তে দেন, সেই বলে, এগুলো সব গাঁজাখুরী গল্প। জোয়ানে ভাবেন, কল্পকাহিনী তো গাঁজাখুরিই হবে, সত্যি হওয়া তো সম্ভব না। একটা বছর কেটে গেলো প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেই। ফলাফল অশ্বডিম্ব, সেটা জেনেছেন ইতিমধ্যে।

আবার সেই কক্ষে ফিরে যাই। প্রকাশক নিগেল নিউটন দাঁড়িয়ে আছেন জোয়ানের সামনে। ভদ্রমহিলার বিশ্বাস হচ্ছে না, একটু আগে লোকটা যা বলেছে তা কি আদৌ তিনি নিজ কানে শুনেছেন? অবশেষে কেউ একজন তাঁর বই ছাপতে চলেছে! ভদ্রলোক বলে চলেছেন- “বুঝলেন, ওই যে চশমা পরা ছেলেটার যে কাহিনীটা, আমার মেয়ের খুব মনে ধরেছে। গল্পের ছেলেটাকে নাকি ওর খুব পছন্দ। পড়ে আমারও মনে হলো, ছাপানো যায়। কেউ পড়ুক না পড়ুক, মেয়েটা খুশী হবে। আপনি আগামীকাল এসে অগ্রীমের টাকাটা নিয়ে যাবেন...!” জোয়ানে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নিউটনের বাকী কথাগুলো তাঁর কান অব্দি পৌঁছুল না ঠিকমতো। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যেই বাড়ী ফিরে এলেন তিনি।
১৯৯০ সালে ট্রেনে চড়ে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডন যাওয়ার সময় এই গল্পের প্লটটা মাথায় এসেছিল তাঁর, একটা ছোট্ট ছেলের গল্প। এতিম ছেলেটা জাদুকরদের স্কুলে যায় জাদুবিদ্যা শিখতে। হগওয়ার্টস স্কুল অব উইচক্র্যাফট এন্ড উইজার্ডরিতে। ছেলেটার নাম হ্যারি; হ্যারি পটার। কোটি কোটি শিশু কিশোরের জীবনের সোনালী সময়টা কেটেছে এই চরিত্রের সাথে। আর আমাদের এই জোয়ানে, সেই হ্যারির স্রষ্টা, যার পুরো নাম জোয়ানে জো রাউলিং ওবিই, যাকে আমরা চিনি জে কে রাউলিং নামে।
লেখা শুরু করার পরে কেটে গেছে কতগুলো বছর, রাওলিং পর্তুগালে গিয়েছেন, বিয়ে করেছেন, মা হয়েছেন, স্বামীকে ছেড়ে আবার ইংল্যান্ডেও ফিরেছেন! পাল্টায়নি হ্যারি, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটা। শৈশবে বাবা-মা হারানো ছেলেটা বইয়ের পাতায় চড়ে হওগার্টসে গিয়েছে, সেই স্কুলটা স্পষ্ট ভেসে ওঠে আমাদের মনের পাতায়। নিজেদের ‘মাগল’ ভেবে আমরা আফসোসে পুড়ি, দুই পায়ের ফাঁকে ঝাড়ু ঢুকিয়ে কিডিচ খেলার চেষ্টা করি! হ্যারি পটার মানেই তো আমাদের কাছে জ্বলজ্বলে স্মৃতির ভাণ্ডার!
প্রথম বই ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্যা ফিলোসোফারস স্টোন’ দিয়েই বাজিমাত করলেন। যদিও বইটা সাড়া ফেলেছে একটু সময় নিয়ে। প্রথম মুদ্রণে প্রকাশিত হয়েছিল এক হাজার কপি। যার মধ্যে অর্ধেক আবার পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিভিন্ন স্কুলের লাইব্রেরীতে। কেউ কিনছে না, কী আর করা! প্রথম মুদ্রণের সেই বইগুলো এখন ইতিহাসের অংশ, সবচাইতে দুর্লভ বইগুলোর কয়েকটি। এগুলোর প্রত্যেকটির দাম নূন্যতম ২৫০০০ পাউন্ড। ভাবা যায়? যেখানে প্রথম বই লিখে রাউলিং ইংল্যান্ড থেকে শুরুতে সম্মানী পেয়েছিলেন মাত্র আড়াই হাজার পাউন্ড!

১৯৯৮ সালে প্রথম দুটো বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন ওয়ার্নার ব্রাদার্স কর্পোরেশানের কাছে। হ্যারি পটার চলে এলো সেলুলয়েডের পর্দায়। তারপর আর অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি রাউলিং-কে। হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো একের পর এক সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করলো। তৈরী হতে থাকলো সিনেমাও। প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার বইটি প্রকাশ হওয়ার প্রথম দিনেই যুক্তরাজ্যে বিক্রি হয়েছিল প্রায় তিন লাখ কপি, আর দুদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয় ৩০ লাখ কপিরও বেশি! হ্যারি পটার সিরিজের সবগুলো বই স্থান পেয়েছে অলটাইম বেস্ট সেলারের ছোট্ট লিস্টে। একটা নির্দিষ্ট সিরিজের সবগুলো বই বেস্ট সেলার হয়েছে, এটা আগামী একশো বছরেও কেউ কল্পনা করবে বলে মনে হয় না।
তাঁর বইগুলো বিশ্বজুড়ে প্রায় সত্তরটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো মিলিয়ন কপি। শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থ বাদে আর কোন বইয়ের এত বিক্রির রেকর্ড নেই। ২০০৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন জে কে রাউলিং এর সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশ করে। আজ থেকে এক যুগ আগেই যা ছিল এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশী। পরের বছর ফোর্বস তাঁকে ঘোষণা করে বিশ্বের দ্বিতীয় ধণাঢ্য নারী হিসেবে, তাঁর আগে ছিলেন শুধু অপরাহ উইনফ্রে। এছাড়া, শুধু লেখালেখি করেই এক বিলিয়ন ডলার আয় করা প্রথম ও একমাত্র লেখকও তিনিই। কিছুদিন আগে তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ এক বিলিয়নের চেয়ে কমে গেছে দান করার কারণে। যে রাউলিং কিনা এর বছর আটেক আগেও নিজের আর মেয়ের খাবার জোটাতে হিমিশিম খেতেন, দুশ্চিন্তায় যিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছিলেন, সেই মানুষটাই এখন চ্যারিটি ফাণ্ড চালিয়ে হাজারো ক্ষুধার্তের মুখে অন্নের যোগান দেন!
বছরের পর বছর ধরে কোটি পাঠককে বিমুগ্ধ করে তিনি আটকে রেখেছিলেন বইয়ের পাতায়। কল্পলোকের মায়াবী জাদুর নগরী থেকে ঘুরিয়ে এনেছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। সমালোচকেরা বলে দিয়েছেন, আরেকটা হ্যারি পটারের জন্ম দেয়া খোদ রাউলিং-এর পক্ষেও সম্ভব নয়। তা না হোক, হ্যারি পটার একবারই জন্মাক। এক জন্মেই যা করে দেখিয়েছে, তা কেউ শত জন্মেও করতে পারবে না। জে কে রাওলিং আমাদের কাছে শুধু লেখক নন, মায়াঘেরা এক স্বপ্নজালের বুননশিল্পীও বটে!
৩১শে জুলাই, ১৯৬৫, ইংল্যান্ডের গ্লুস্টারশায়ারের ইয়েটে জন্মগ্রহন করেছিলেন এই ক্ষণজন্মা নারী। জে কে রাউলিং, ধন্যবাদ আপনাকে, আমাদের শৈশবে সোনাঝরা কিছু স্মৃতির ভাণ্ডার উপহার দেয়ার জন্যে। আজ আরো একজনের জন্মদিন। চশমা পরা সেই ছেলেটা, আমাদের বইয়ের পাতার প্রথম প্রেম, হ্যারি পটার নাম যার।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন