
প্রথমে ক্যারিয়ারের জন্য যুদ্ধ, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ, তারপর ২০১৮ থেকে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ। সিনেমা জগতের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার তিনি বীর যোদ্ধাই বটে।
শাওনি রুদ্র তিতলি: মনে আছে, 'দ্যা লাঞ্চবক্স' এর সেই মধ্যবয়স্ক নিঃসঙ্গ পুরুষটার কথা! মাত্র ৪৫ বছর বয়সে একজন বৃদ্ধ চরিত্রে সাবলীল একজন মানুষ, লোকাল ট্রেনের ঝাঁকি খেয়ে নয়টা-পাঁচটার জীবন কাটাচ্ছে, কোথা থেকে ভুলে এক বাসায় বানানো লাঞ্চবক্স চলে আসে..ছোট্ট সাধারণ একটা গল্পের অসাধারণত্ব আসে যে মানুষটার কারণে, ‘ইরফান খান’।
সকাল বেলায় খবর পেলাম ইরফান খান কোলন ইনফেকশনে মারা গেছেন। ঠিক সেই কোলন ইনফেকশন, যাতে মারা গেছেন বাংলাদেশের হুমায়ুন আহমেদ, আবার বাংলাদেশের একটি মাত্র সিনেমায়ই ইরফান খান অভিনয় করে গেছেন, তাতে সিনেমায়ও তিনি মারা যান কোলন-ইনফেকশনে। জীবন আসলে কত রহস্যময়!
চারদিন আগে যার মা মারা গেলেন, মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনি যেতে পারলেন না লকডাউনে বন্দি হয়ে। আমার তখন তাঁরই অভিনীত ‘Life of pi’ সিনেমার একটি ডায়লগ মনে পরে গেল-
‘I suppose in the end the whole of life becomes an act of letting go. But what always hurts the most is not taking a moment to say goodbye’.

‘বিল্লু বারবার’ সিনেমায় অসহায় দরিদ্র এক নাপিত, আবার ‘গুন্ডে’ সিনেমায় একজন কাটখোট্টা পুলিশ। ‘পিকু’ সিনেমায় একজন খুব সাধারণ চরিত্র। চরিত্রের কোনো মারামারি নেই, ধুমাধারাক্কা একশন নেই, নেই রাশভারী কোনো ডায়লগ। অভিনয় করতে নেমে অভিনয় না করা যে কেমন, তাই যেন দেখা গেল পিকু সিনেমায়। ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ সিনেমার সেই হাসি-খুশি লোকটা, আবার ‘হিন্দি মিডিয়াম’ সিনেমার সদ্য হওয়া বড়লোকের চরিত্র- প্রত্যেকটায় কী অসাধারণ তিনি, অথচ কী সাধারণ!
একজন অভিনেতা তাঁর এক জীবনে কত জীবন কাটিয়ে দেয়, তাই ভাবি! জীবন আসলে যুদ্ধ! জয়পুরের ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে উঠে এসে বাবা মারা যাওয়া এক ছেলের ফিল্ম স্কুলে জয়েন করা যে কতটা কঠিন ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ, এখন বুঝি। দীর্ঘদিন টেলিভিশনে তাঁর আটকে পরা জীবন ছাড়া পায় অনিশ কাপাটিয়ার ‘ওয়ারিওর’ দিয়ে। যার প্রথম সিনেমা ‘ওয়ারিওর', বাকিটা জীবন যে তাঁর যুদ্ধে কাটাতে হবে, এটাই হয়ত বিধাতা লিখেছিলেন তার ভাগ্যে।
প্রথমে ক্যারিয়ারের জন্য যুদ্ধ, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ, তারপর ২০১৮ থেকে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ। সিনেমা জগতের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার তিনি বীর যোদ্ধাই বটে। তারপর হেরে যেতে হলো জীবন যুদ্ধে, যোদ্ধার মতো বাঁচলে কয়জনই বা বাঁচতে পারে! তাও ইরফান খান নেই, খবরটা শুনে মনে হয়, আহা জীবন, আহারে জীবন!