কোন থিয়েটার বা ড্রামা স্কুল ইরফানকে চোখের এই অভিনয় শেখায় নি। চোখের নিজে শিখে নিতে হয় সেটা। চোখকে দেখতে হয় গভীরভাবে। দেখতে হয় জীবনকে, জীবনের বাস্তবতাকে।

Let everything happen to you: beauty and terror.

Just keep going. No feeling is final.

Don’t let yourself lose me.

রাইনার মারিয়া রাইকের এই কবিতা ইরফান খান শেয়ার করেছিলেন ২০ মার্চ ২০১৮ তে। তখন তিনি লড়ছিলেন তার শরীরে দানা বাঁধা রোগের সাথে। ২ বছর কেটে গেছে, ইরফানের করে যাওয়া কাজে আমরা তাকে দেখেছি কদিন আগেও। কিন্তু এই দুই বছর ইরফানকে লড়তে হয়েছে। ইরফানের পরিবারকে লড়তে হয়েছে এই রোগের সাথে। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে কী বুঝি! একসিডেন্ট ছাড়া যেকোনো মৃত্যুই স্বাভাবিক বলে মনে করি আমরা, নিজেরাও মনে মনে চাই যে বিধাতা পরিবারকে কাছে রেখে নিজের বিছানাতেই যেন মৃত্যু দেয়। কিন্তু একেকটা রোগ যখন শরীরকে বছরের পর বছর ধরে কুরে কুরে খায় আর পরিবার ও নিজের ওপর দিয়ে হাসপাতাল-বাসা-টেস্ট-রিপোর্ট-সার্জারি ইত্যাদি একের পর এক যেতেই থাকে, তখন অনেকেরই মনে হতে পারে যে একসিডেন্ট হলেই ভালো হতো, এক নিমিষেই শেষ। অন্তত পরিবারের ওপর দিয়ে এতো ঝড়-ঝাপটা যেত না। ইরফান তবুও হার মেনে নেন নি, তিনি কবিতার মধ্য দিয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তার সাথে যেমন ভালোটাও হয়েছে তেমনি খারাপটাও হবে আর তিনি প্রস্তুত, কারণ তার সাথে সৃষ্টিকর্তা আছে সবসময়।

আঁধারের পরই আলো আসে। আলোর পরই অন্ধকার। ডলবি থিয়েটারের অস্কারমঞ্চ যেমন দেখা আছে ইরফানের তেমনি দেখা ছিল বোম্বের কানাঘুপচি গলিতে থাকা কাস্টিং ডিরেক্টরের অফিসও। হাজার কোটি টাকা বাজেটের সিনেমায় পাই প্যাটেল হওয়া ইরফান লাখ টাকা বাজেটের সিনেমায় পাসিং শটও দিয়েছেন প্রচুর। তিনি ভালোমতই জানতেন সব খারাপের পর ভালো সময় ঠিকই আসে আর যখন আসে তখন তা আলোয় উদ্ভাসিত করে দেয়। ইরফান হয়তো ভেবেছিলেন এই খারাপ সময়টাও ঠিক কেটে যাবে। তিনি আবার ফিরবেন, কিছু না বলা গল্প বলবেন। কিন্তু এবার আঁধারের পর আলো এলো না। তিনি একা নন, আমাদের সবাইকে নিয়েই নিমজ্জিত হলেন চির অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। আর কোনদিন স্ক্রিনে দেখা হবে না সেই উৎসুক চোখ, সেই সরল অভিনয়।

*

ইরফানের চোখ আলাদা অভিনয় জানতো। কোন থিয়েটার বা ড্রামা স্কুল ইরফানকে চোখের এই অভিনয় শেখায় নি। চোখের নিজে শিখে নিতে হয় সেটা। চোখকে দেখতে হয় গভীরভাবে। দেখতে হয় জীবনকে, জীবনের বাস্তবতাকে। সব হারিয়ে ফেলা ফ্যালফ্যাল করে দেখতে হয়, প্রিয়জনের মৃত্যু দেখতে হয় ঐ দু চোখ দিয়ে, দুই চোখে লুকোতে হয় প্রগাঢ় ভালোবাসা, আর ঐ চোখ দিয়েই রাগ-ঘৃণা-দুঃখ ঝরাতে হয়। তখন গিয়ে চোখ এমন অভিনয় জানে। এই চোখের অভিনয়ে ইরফান কোন রাখঢাক রাখেন নি। সুযোগ পেলেই দেখাতেন সে অভিনয়।

মানুষটার চোখ আলাদা অভিনয় জানতো...

মকবুলে আব্বাজিকে প্রতিনিয়ত ধোঁকা দেয়া মকবুল সরাসরি সেটা প্রকাশ না করলেও তার চোখ ঠিকই শুরু থেকে প্রকাশ করে আসছিল। নেইমসেকে অশোক গাঙ্গুলি অসীমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ না করলেও তার চোখ ঠিকই করতো। পান সিং তোমারে ভয়ানক ডাকাত পান সিং এর চোখে কেমন যেন বিষাদ খেলা করতো। ডুবে বিচ্ছিন্ন পরিবারের কষ্টে জাভেদ হাসান একবার না কাঁদলেও তার চোখ ঠিকই কাঁদছিল।

ইরফান চোখ দিয়ে অনেক গল্প বলে গিয়েছেন। আরও অনেক গল্প বলতেও চেয়েছিলেন। তার শেষ সিনেমা আংরেজি মিডিয়াম দেখেছিলাম কিছুদিন আগে, সেখানেও রোগে জর্জরিত ইরফানকে দেখে মনে হয় নি এটাই তার শেষ গল্প। বরং ইরফান আমার মাঝে থাকুক তার প্রস্থানের আগে আমার দেখা তার শেষ সিনেমার শেষ দৃশ্যের মাঝে। লাঞ্চবক্স সিনেমাটা আমি কেন যেন দেখি নি বছরের পর বছর ধরে। জমিয়ে রাখছিলাম কোন এক অজানা কারণে। অবশেষে দেখা হল এমন একদিন যেদিন ইরফানের মা মারা যান। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা ছিল। এই তো ক’দিন আগের কথা। সাজান ফার্নান্দেজরূপি ইরফান আর্লি রিটায়ারমেন্টে চলে যাবেন, এরই মাঝে লাঞ্চবক্সের অদল-বদল তার জীবনেও অদল-বদল ঘটিয়ে দিলো। সাজান আর ইলার অদেখা প্রেমের সাক্ষী হয়ে রইলাম। ইলা চেয়েছিল সাজানকে কাছে পেতে কিন্তু সাজান বাস্তবতার ভয়ে পিছপা হয়েছে বারবার। শেষমেশ সাজানই খুঁজতে বের হয় ইলাকে। ডাব্বা সার্ভিসের লোকজনদের ধরে খুঁজে বের করতে চায় ইলার ঠিকানা। ইলাকে খুঁজে পেয়েছিল কীনা জানা যায় নি সিনেমাশেষে। কিন্তু বাসে চড়ে ইলাকে খুঁজতে বের হওয়া সাজান ফার্নান্দেজের হাসি ঠিকই নিশ্চয়তা দিয়ে গিয়েছিল যে আর যাই হোক ইলাকে তিনি খুঁজে বের করবেন এবং দুজন একটা সুন্দর জীবন যাপন করবেন।

সাজান ফার্নান্দেজ অর্থাৎ ইরফানের সে হাসিটাই শেষ ছবি হয়ে থাক ওর আমার চোখে। মনে করে নেই ইরফান সাজান হয়ে নিজের জন্য একটা সুখি জীবন নিশ্চিত করে নিয়েছেন, এবার তিনি অবসরে। আর সিনেমা-টিনেমা করার দরকার নেই। ভুটানে গিয়ে রেডিও ভুটানে অদ্ভুত মিষ্টি সুরের ভুটানি গান শুনছেন। পাশে বসে আছে তার ভালোবাসার মানুষ। হ্যাঁ, এটাই শেষ দৃশ্য হয়ে থাক।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা