আপনি আমার প্রিয় অভিনেতা নন। ভালো লাগে, আপনার অভিনয় পছন্দ করি, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকি পর্দায়- এটুকুই তো। তাহলে আপনার চলে যাওয়ায় কেন আমি হাউমাউ করে কাঁদব? আপনার জন্যে কেন আমার চোখজোড়া পুড়বে?

সকালটা এমন দুর্বিষহভাবে শুরু হবে, কে জানতো? ভোররাতে পিকু দেখছিলাম বসে বসে। ইরফানের হিউমার, ড্রাই কমেডি, দীপিকার সঙ্গে অদ্ভুত একটা কেমিস্ট্রি- যেখানে গ্ল্যামার নেই, আছে মায়া, চারিত্রিক বৈপরীত্যের দুটো মানুষের মধ্যে অদ্ভুত একটা মেলবন্ধন- সবটাই মুগ্ধতা জাগানিয়া, তাই অনেক দিন বাদে আবার এই পুরনো জীর্নতায় ডুব দেয়া। তখন কি ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলাম, ঘুম ভেঙে উঠেই শুনতে হবে খবরটা- ইরফান খান আর নেই!

কেন ইরফান? খুব দরকার ছিল এই মধ্যপঞ্চাশে অনন্ত যাত্রার? আপনি তো ফাইটার, ক্যান্সারকে জয় করে ফিরেও এসেছিলেন, তবু কেন হার মানলেন এই বেলায়? পান সিং, যোগী, ফার্নান্ডেজ, বিল্লু, রানা, রাজ বাত্রা- এই চরিত্রগুলো দিয়ে কেন আপনাকে স্মরণ করতে হবে? চরিত্রগুলো না থেকে বরং আপনি মানুষটাই থেকে যেতে পারতেন না? গত তিন দশকে ভারত যতো গুণী অভিনেতা পেয়েছে, তাদের মধ্যে অভিনয়ের মাপকাঠিতে নিঃসন্দেহে আপনি সবার সেরা। আপনাকে কেন ৫৪ বছর বয়সে বিদায় নিতে হবে? এটা তো চলে যাওয়ার সময় নয় ইরফান!

দ্য লাঞ্চবক্স সিনেমাটা আমার কত প্রিয়, সেটা আপনি জানেন না ইরফান। প্রায় প্রতিটা ডায়লগ আমার মুখস্ত, চিঠি পড়ার সময়, ডায়লগ ডেলিভারির সময় আপনার অভিব্যক্তিগুলো আমার চোখে ভাসে শুধু। সাধারণ একটা ছাপোষা চরিত্রকে কীভাবে মেথড অ্যাক্টিং দিয়ে অসাধারণ করে তুলতে হয়, সেটা আপনি দেখিয়েছিলেন। কিংবা ‘পান সিং টোমার’- আমার চোখে আপনার সেরা কাজ- অর্ধেকটা দেখার আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, ভারতের কারো পক্ষে পান সিংয়ের রোলটা আপনার চেয়ে ভালোভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।

পান সিং টোমার

হাসিল, মকবুল, দ্য নেমসেক, বিল্লু, লাইফ অফ পাই, হায়দার, পিকু, তালভার, মাদারি, হিন্দি মিডিয়াম, কারিব কারিব সিঙ্গেল, কারওয়ান, ডুব— কয়টার কথা বলব? প্রতিটা সিনেমা ভীষণ পছন্দের, প্রতিবার মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন আপনি, মনের ভেতরে আপনার নামে যে জায়গাটুকু বরাদ্দ রাখা আছে, সেটার পরিমাণ বেড়েছে প্রতিবার। কারিব কারিব সিঙ্গেলের যোগী চরিত্রটা আমার কতটা পছন্দের, কত কাছের- সেটা কেউ জানে না। আপনাকে আমি কতটা পছন্দ করি, সেটাও তো আমি নিজে জানতাম না। আজ জানলাম, কিন্ত এভাবে জানার কি খুব দরকার ছিল ইরফান?

আপনি শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন, নিজের মনের কথা শুনেছিলেন বরাবর। আর তাই পারিবারিক ব্যবসা ফেলে রেখে, প্রত্যাশা আর দায়-দায়িত্বের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে বেছে নিয়েছিলেন অনিশ্চিত জীবন। দিল্লির এনএসডির দিনগুলোতে পৃথিবী আপনাকে তার কঠিন রূপটা দেখিয়েছে। হাতে কাজ নেই, পকেটে টাকা নেই, এরমধ্যে প্রেম হয়ে গেছে, মীরা নায়ার আপনাকে সিনেমায় নিয়েও আবার বাদ দিচ্ছেন- কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটলো কয়েকটা বছরে! নাটকে আপনার অভিনয় খারাপ হয়েছে- এই অজুহাতে প্রোডাকশন ম্যানেজার অর্ধেক টাকা কেটে রাখছে আপনার কাছ থেকে- ভাগ্যদেবতা কি তখন মুচকি হেসেছিল আপনার দিকে চেয়ে? বলেছিলেন, নাটকের তো সবে শুরু, কত কিছু যে আরও বাকি আছে!

আপনি পাতালে বাস করেছেন, আপনি আকাশও ছুঁয়েছেন। অর্ধেক পারিশ্রমিক পাওয়া, সিনেমা থেকে বাদ পড়া আপনি নিজেকে পরিণত করেছেন সময়ের সেরা অভিনেতা হিসেবে, ছোট্ট টাইপিস্টের ক্যারেক্টার থেকে ভিলেন, কিংবা ছাপোষা চাকরিজীবি থেকে কুখ্যাত ডাকাত, অথবা সন্তান হারানোর ক্ষোভ বুকে চেপে প্রতিশোধের নেশায় ঘুরে বেরানো এক পিতা- সব চরিত্রেই দুর্দান্তভাবে প্রমাণ করেছেন নিজেকে। আপনার দ্যুতি ভারত পেরিয়ে পৌঁছে গেছে সুদূর হলিউডে, বাঘা বাঘা পরিচালকেরা আপনার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন, হীরে চিনতে তারা ভুল করেননি। ভারতের দর্শকের কাছেও আপনার কদর বেড়েছে, আপনার সিনেমা একশো কোটির ব্যবসা করেছে, পপুলার ক্যাটাগরিতে হাতে উঠেছে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। একাদশে বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকার কথা ছিল আপনার, অথচ কি হলো তার জায়গায়?

ইরফান খান

হাই-গ্রেড নিউরোএন্ডোক্রাইন ক্যানসার নামের এক জটিল রোগ বাসা বাঁধল আপনার শরীরে, বছর দুয়েক আগের ঘটনা সেটা। চিকিৎসার জন্যে আপনি উড়ে গেলেন লণ্ডনে। শুটিং থামলো, রোগটা কাবু করে ফেললো আপনাকে। আপনি অনন্ত পথের যাত্রী, হঠাৎ যেন কোনও টিকিট চেকার এসে কাঁধে টোকা মেরে জানিয়ে গেলেন আপনার সফর শেষ... এবার নেমে যেতে হবে। ভাগ্যদেবী আপনাকে নিয়ে নতুন এক খেলা শুরু করলেন, সেই খেলায় আপনি বড় অসহায় এক ক্রীড়নক মাত্র!

তবুও আপনি আশা দেখালেন, বললেন, সবার ভালোবাসায় আপনি আপ্লুত, এই ভালোবাসাকে শক্তি বানিয়েই আপনি ফিরবেন। আপনি ফিরলেনও, ইংরেজী মিডিয়াম করলেন, উধম সিং বায়োপিকের কাজ শুরু করার কথা সুজিত সরকারের সঙ্গে, কয়েকদিন বাদেই। যে সুজিত আপনাকে একটা পিকু দিয়েছিল, সেই সুজিতকে কেন সকাল সকাল টুইট করে জানাতে হবে, আমার বন্ধু ইরফান না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন… কেন আপনি কথা রাখতে পারলেন না ইরফান?

আপনার একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম কিছুদিন আগে, বেশ কয়েক বছরের পুরনো। আপনি বলছিলেন, “যেদিন আমি স্রোতে গা ভাসাব, সেদিন আমার ভেতরের অভিনেতার আত্মাটার মৃত্যু হবে।” অভিনয়টা আপনার কাছে ধর্মের মতো ছিল, আপনার প্রথম ভালোবাসা ছিল। সেটার সঙ্গে আপোষ করেননি আপনি, ভার্সেটাইলিটি ধরে রেখেছেন শেষ অবদি, ক্লিশে হননি, জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভেসে যেতে দেননি নিজেকে। এই জায়গায় আপনি ওয়াদা ভাঙেননি একটুও।

নিজের সিনেমার সংলাপের মতো করেই কেন বিদায় নিতে হবে ইরফান?

ইরফান, মৃত্যু শাশ্বত, সবাইকে যেতে হবে। কিন্ত এভাবে অবেলায় কেন? লাইফ অফ পাই সিনেমায় আপনার গলায় একটা সংলাপ ছিল- ‘যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, সেটা হচ্ছে শেষবার বিদায় বলার জন্যে একটুও সময় না পাওয়া…’ কেন সেই সংলাপের মতোই একদম না বলে, ব্যথা বুকে নিয়ে আপনাকে চলে যেতে হবে? পিকুতে আপনি যখন বললেন, ডেথ এন্ড শিট ক্যান কাম এনি টাইম, এট এনহোয়্যার- সেটা শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিলাম কয়েক ঘন্টা আগে। সেই দৃশ্যটাই যে এখন ট্র্যাজেডি হয়ে বুকের গহীনে বেদনার বীজ বুনে দিচ্ছে, এই কষ্ট সহ্য করি কি করে?

আপনি আমার প্রিয় অভিনেতা নন, আপনাকে আমার ভালো লাগে, আপনার অভিনয় আমি পছন্দ করি, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকি পর্দায়- এটুকুই তো। আপনার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হবার দূরতম সম্ভাবনাও ছিল না, ছিল না গভীর কোন সম্পর্ক বা ভালোবাসাও; তাহলে আপনার চলে যাওয়ায় কেন আমি হাউমাউ করে কাঁদব? আপনার জন্যে কেন আমার চোখজোড়া পুড়বে? আপনার বিদায়ে কেন আমার পৃথিবী কয়েক মুহূর্তের জন্য টালমাটাল হয়ে যাবে, কেন প্রিয়জন হারানোর মতো কষ্ট পাব আমি? এই রহস্যের কি কোন সমাধান আছে?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা