এই মানুষটা হুইলচেয়ারে বসেই ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নার্সের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিছু মানুষ হুইলচেয়ারে চলাফেরা করলেও, তাদের কর্মশক্তি দুই পায়া অনেক মানুষদের চেয়ে অনেকখানি বেশি...

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বিশ্বাস করতেন সৃষ্টিকর্তা তাকে মানুষের সেবা করবার জন্যেই পাঠিয়েছেন। তিনি এমন এক সময়ে সেবিকা হিসেবে কাজ করেছেন যা নারীদের জন্য প্রতিকূল সময়। তখন কেউ সেবিকার কাজ করতে চাইতো না। মেয়ে সেবিকা হোক, চায়নি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের বাবা-মাও। সেই মেয়েটি আজ আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত হিসেবে বিশ্বে স্মরণীয়। রুপসী এই নারী ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিপর্যস্ত আহত সৈনিকদের সেবায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, তাকে সৈন্যরা বলতে শুরু করেছিল, 'ক্রিমিয়ার ফেরেশতা'!

এসব মহৎ ঘটনা নিশ্চিতভাবেই অনুপ্রেরণার। তবে আমাদের বাংলাদেশেও এমন ফেরেশতার মতো কিছু মানুষ আছেন যারা গোটা জনম শত প্রতিকূলতার বিপরীতে ব্যয় করেন মানবতার জন্যে। আজ তেমন একজন মানুষের গল্প বলবো, যাকে দেখে এবং যার আত্মত্যাগী মনোভাব দেখে মনে হয় ইনি আমাদের ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ইনি আমাদের ভীষণ আপনজন। মানুষটার নাম ইরানি বাড়ৈ।

অক্ষমতা বোধহয় ইচ্ছে আর সাহসের অনুপস্থিতি। কিন্তু, কিছু মানুষের এই দুইটি জিনিস একেবারে অফুরন্ত- ইচ্ছে, সাহস সাথে অসীম মনোবল। তাদের জীবনে কোনো কিছুই নিজের ইচ্ছের কাছে বাঁধা হতে পারে না৷ ইরানি বাড়ৈ তেমনই একজন নারী। সত্যি বলতে তাকে যদি আপনি কখনো সাদামাটা পরিস্থিতিতে দেখেন, আপনার মায়া লাগবে এই ভেবে, আহারে মানুষটার বোধহয় হুইলচেয়ারে চলতে কষ্ট হচ্ছে।

অনুপ্রেরণার অপর নাম যেন ইরানি বাড়ৈ

কেউ হুইলচেয়ারে চলাফেরা করলে তাকে একটু অক্ষম মনে হতেই পারে, মনে হতেই পারে মানুষটা স্বাভাবিক মানুষের মতো চলতে ফিরতে পারে না। কিন্তু, এরকম মনে হলেও কিছু এসে যায় না৷ কিছু মানুষ প্রতিবন্ধকতাকে এমন করে জয় করেন যে, প্রতিবন্ধকতা শব্দটাকেও কেমন অচল অচল মনে হয়। কিছু মানুষ হুইলচেয়ারে চলাফেরা করলেও, তাদের কর্মশক্তি, প্রাণ প্রাচুর্য, উদ্যম দুই পায়া অনেক মানুষদের চেয়ে অনেকখানি বেশি। ইরানি বাড়ৈ তেমন একজন মানুষ। তাকে যখন আপনি নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে দেখবেন, তখন বিস্ময় এবং শ্রদ্ধাবোধে আপনার মন ভরে উঠবে। তিনি হুইলচেয়ারে বসেই আজ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নার্সের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখছেন। 

১৯৯৬ সালে একবার প্রবল জ্বর আসলো। তখন থেকে সমস্যাটা শুরু হয়েছিল। ডাক্তাররা ধরতে পারেনি। জ্বরটা খতরনাক হয়ে উঠেছিলো, হাত আর দুই পা পক্ষাগাতগ্রস্থ হয়। প্যারালাইজড হয়ে পড়ায় তখন থেকেই তাকে হুইলচেয়ারে চলতে ফিরতে হয়। শুরুতে ভেবেছিলেন, এরকম অবস্থায় হয়ত নার্সিং পেশাটাকে ছাড়তে হবে। কিন্তু তিনি ভালবাসেন পেশাটাকে। এত সহজে ছেড়ে দিবেন? এতদিনের অভিজ্ঞতা।

অসুস্থ হওয়ার দশ বছর আগে থেকে এই পেশায় জড়িত, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে নার্সিংয়ের উপর ডিপ্লোমা নিয়েছিলেন। এই মানবিক পেশাটার উপর মায়া পড়ে গিয়েছে। তাছাড়া, কোনো কোনো মানুষকে ভালবাসার নেশায় ধরে। নার্সিং পেশাটা শুধু নিছক একটা পেশা তো নয় তার কাছে, এটা এক ভালবাসা। তাই তিনি ছাড়তে পারলেন না। ফিরে আসলেন এক বছর বাদে। অসুস্থ হওয়ার পর সাভারের সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডে এক বছরের আরেকটি ডিপ্লোমা করেছিলেন। তারপর ফিরে আসেন কর্মক্ষেত্রে।

নিজ কর্মস্থলের সামনে

বর্তমানে তিনি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ডাইরিয়া ওয়ার্ডে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে চাকরি করছেন। অসুস্থ হবার আগে ঠিক যেভাবে নার্স হিসেবে সেবা দিতেন, এখনো ঠিক ওরকম, একই মমতায় ও দায়িত্বনিষ্ঠায় সেবা দিচ্ছেন রোগীদের৷ প্রতিদিন সময় মেনে ঠিক হাজির হয়ে যান হাসপাতালে। তারপর কাজে ডুবে যান। অথচ, হুইলচেয়ারে বসে নার্স হিসেবে কাজের শুরুর দিনগুলোতে অনেকে হয়ত তাকেই রোগী বলে ভুল করত। এখনো যে হুট করে কেউ ভুল করে না, তা কে বলতে পারে!

তাতে কী এসে যায়? তিনি যেভাবে নার্সিং পেশাকে ভালবেসেছেন, রোগীদের সেবা করছেন সেটা এক বিশাল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। রোগীরাও হয়ত তাকে দেখে মনোবল পায়। আর নার্সিং পেশার জন্যও ইরানি এক গর্বের নাম। ইরানির সহকর্মীরা তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। মাহমুদা খানম নামের একজন সিনিয়র নার্স বলেন, 'ইরানি খুবই দক্ষ নার্স। হাঁটতে না পারলেও অন্য নার্সদের মতই সব ধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার সেবায় অনেক মুমূর্ষু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।' 

৫১ বছর বয়সী ইরান বাড়ৈ স্বপ্ন দেখেন আজন্ম সেবাকাজের সাথে যুক্ত থাকার। তিনি বলেন, 'মানুষের সেবা করার স্বপ্নই আমি সারা জীবন লালন করেছি। কয়েক বছর পর আমার অবসর নিতে হবে। এরপর যেন মানুষের পাশে থাকতে পারি, তাই একটা পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।' 

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলরা যেমন বারে বারে জন্মায় না কিন্তু অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, আমাদের 'ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল' ইরানি বাড়ৈ আমাদের জন্য তেমনই একটা নাম। তিনি প্রমাণ করে দিচ্ছেন, মনের জোর আর ইচ্ছেশক্তি থাকলে হুইলচেয়ারে বসেও সেবকের কাজ করা যায়! স্যালুট ইরানিকে, আপনিই কারো কারো জন্যে মনের জোর।

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা