'বুদ্ধিজীবীরা যদি এতো বৃদ্ধিমান হয়, তাহলে একাত্তরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে ছিলেন কেন?' 'পাকিস্তান কেনই বা এ দেশের সকল মেধা ধ্বংস করে দিয়ে এদেশকে ভারতের মেধায় চলার জন্য বাধ্য করবে?' বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে এধরনের মুখরোচক আলোচনা নিশ্চয়ই আপনিও শুনেছেন...
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, মঙ্গলবার: এই দিন থেকে আড়াই বছর বয়সী শমীকে আর দুধ খাওয়ানো যায় নি। শুধু দুধ না দুধ দিয়ে বানানো যে কোনো খাবার তার মুখে তোলা যায়নি ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। দুধ বা দুধের তৈরি যে কোনো খাবার তার সামনে আনলেই প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠতো। কেন? কারণ সেদিন সন্ধায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে পান্না কায়সার বসার ঘরে এসে দেখেন, তার স্বামী শমীকে কোলে নিয়ে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছে। রেডিওতে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের মুক্তির খবর ভেসে আসছে। পান্না কায়সারের ভাষায়-
"দুধ তৈরী করে নিয়ে এলাম। শমীকে ওর কোল থেকে নিয়ে নিচে নামিয়ে বসেই ওকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। নিচ থেকে দেবর এসে বললো, “বড়দা, বাইরের গেটে কয়েকজন লোক গেটের তালা খোলার চেষ্টা করছে, ভেতরে আসতে চায়”। কারফিউ পরার সাথে সাথে বাহিরের গেটেও তালা দেওয়া হয়। বলা যায় না- অন্ধকারে কেউ যদি ঢুকে পড়ে! মিয়ার কথা শোনার সাথে সাথেই শহীদুল্লাহ্ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “খুলে দাও। নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা”। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শত্রুমুক্ত হবার খবর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে শুনেছি। রাজধানী ঢাকা শহর মুক্তি সেনারা ঘিরে ফেলেছে। সে খবরও আমাদের কানে এসেছে। উৎকণ্ঠার সঙ্গে আমরা কেবল বিজয়ের অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে মিয়ার এ খবরে শহীদুল্লাহ্ ভাবলো নিশ্চয়ই মুক্তি সেনাদেরই কেউ। মিয়াকে দরজা খুলে দেয়ার কথা বলেই তরিৎ গতিতে শোবার ঘরে লুঙ্গিটা পাল্টিয়ে প্যান্ট পরে বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তখনও শমীকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। ওদের আসতে দেরী দেখে শহীদুল্লাহ্ ফোন করলো জহুর মামাকে। কিন্তু ওনাকে ফোনে পাওয়া গেল না।
রাজাকাররা ভিতরে ঢুকেই সকলকে আটকে ফেলেছে। যার জন্য ওদের উপরে আসতে দেরী হচ্ছিল। সবাই নিচে আটকে পড়ায় উপরে কোনো খবরও দিতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর তিন-চার জন লোক টপ টপ করে উপরে উঠে এলো। ওদের সবার মুখই কালো কাপড়ে বাঁধা। ব্ল্যাক আউটের কারণে ঘরে মোমবাতি জ্বলছিল। ঠাওর করা যাচ্ছিল না কিছুই। ঘরে ঢুকেই একবার ওরা চারিদিকে তাকাল। তখন ওই ঘরে ছিল শহীদুল্লাহ, চাচা ও আব্বা। আমি শমীকে কোলে তুলে দুধের শিশি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বেজন্মা রাজাকারেরা শহীদুল্লাহ্’র দিকে তাকিয়ে ওর নাম জিজ্ঞেস করলো। 'আমার নাম শহীদুল্লাহ্ কায়সার'। ওর গলা দিয়ে যেন তখন আগুন ঝরছিল। শহীদুল্লাহ ওর নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরগুলো ওর হাতটা ধরে টান দিয়ে বললো; “চলুন আমাদের সঙ্গে!” শুনেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। দুধের শিশিটা ছিটকে পড়লো মাটিতে, শমী পড়ে গেল কোল থেকে।"
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, সোমবার: দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। কোনো কোনো অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। আমরা তখন ছিলাম সিদ্ধেশ্বরীতে, তৎকালীন ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে। আমাদের বাসায় আমরা তিনজন মানুষ- আমি, মা আর আমাদের উজির মামা। সেদিন শীতের সকালে আমরা ছাদে ছিলাম। মা আমার গায়ে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন, একটু পর গোসল করতে নিয়ে যাবেন। আমি ছাদে খেলাধুলা করছি, আর মা একটা চেয়ার টেনে কী যেন লিখছেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে।
হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। আমাদের বাসার উল্টো দিকে খান আতা'র বাসার সামনে E.P.R.TC- এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামে। সেই বাসার প্রধান গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু লোক। আমরা তিনজন ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্যটা দেখলাম। কিছুক্ষণ পর মা আমাকে গোসল করানোর জন্য নিচে নিয়ে আসেন। গোসলের পর আমি আবার ছাদে চলে যাই। আর মা যান রান্না করতে। ছাদে আমার সঙ্গে উজির মামাও ছিলেন। এরপর আবার গাড়ির শব্দ। এবার একটি গাড়ি এসে থামে আমাদের বাসার সামনে।
ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখি কয়েকজন লোক আমাদের বাসায় ঢুকছে। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এরা বাসার প্রধান লোহার কলাপসিবল দরজার কড়া নাড়ছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বের হয়ে কলাপসিবল গেট খুলে দেয়। গাড়িতে করে আসা লোকগুলো ভদ্রলোকের কাছে সেলিনা পারভীনের পরিচয় জানতে চায়। ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন। ভদ্রলোককে ঘরে চলে যেতে বলে লোকগুলো আমাদের ফ্ল্যাটে এসে কড়া নাড়ে। মা দরজা খুলে দেন। লোকগুলো মার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং বাসায় কে কে থাকে তাও জেনে নেয়। এ সময় মার সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়।
আমি আর উজির মামা ততক্ষণে সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা উঁকি দিলে ওরা দেখে ফেলে। আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। আমি ও উজির মামা ভয় পাই। মা আমাদের ডেকে নিয়ে লোকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি মার কাছে চলে আসি। এরপর মাকে তাদের সাথে যেতে বলে লোকগুলো। মা লোকগুলোকে বলেন, 'বাইরে তো কারফিউ। এখন যাব কীভাবে?' লোকগুলো বলে, 'আমাদের সাথে গাড়ি আছে। তাছাড়া আমাদের সাথে কারফিউ পাশও আছে। কোনো সমস্যা হবে না।' ওরা নাছোড়বান্দা, আম্মাকে নিয়ে যাবেই। মা তখন বলেন, 'ঠিক আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি বদল করে আসি।' ওরা বাধা দেয়। বলে, 'দরকার নেই। গাড়িতে করে যাবেন আবার গাড়িতে করেই ফিরে আসবেন।' আমিও তখন মার সাথে যেতে চাই। কিন্তু লোকগুলো আমাকে ধমক দিয়ে বলে, 'বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা।' উজির মামা কিছু বলতে চাইলে তাঁকেও বলে, 'বাড়াবাড়ি করবেন না।'
আমি তখন মার খুব কাছে। তাঁর হাত ধরে আছি। মা আমার মাথায় হাত বুলান। তিনি আমাকে বলেন, 'সুমন, তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব।'
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, মঙ্গববার দুপুর: বেলা ১টার দিকে জানালায় কাদামাখানো এবং ছাদে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢাকা একটি মিনিবাসে করে তিন/চারজন তরুণ এসে হাতিরপুলের সেন্ট্রাল রোডে আমার দাদার বাড়ির লোহার গেইটে ধাক্কা দেয়। আমার চাচা শমসের চৌধুরী রুশো গেইটের দিকে এগিয়ে গেলে উনাকে তারা প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি মুনীর চৌধুরী’। তিনি বলেন, 'মুনীর চৌধুরী আমার বড় ভাই'। তারা তখন বাবাকে ডেকে দিতে বলে। তিনি দোতলায় গিয়ে বাবাকে খবর দিলে বাবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় কাকাকে নিয়ে নিচে নামেন। বাবা ও কাকার সঙ্গে আমার মাও নিচে নেমে আসেন। কাকা গেইটের তালা খুলে দিলে বাবা ওই যুবকদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কী চাও?’ ওই যুবকরা তাকে বলে, ‘স্যার আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে’। তখন বাবা তাদের জিজ্ঞেস করেন ‘তোমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে?’। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন ‘আছে’ বলেই বাবার পেছনে বন্দুক ধরে। তখন আমার বাবা কাকার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘রুশো, তাহলে যাই”। ওরাই আমার বাবাকে ঠেলে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ১৩,১৪,১৫ই ডিসেম্বর এভাবেই আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীদের যাদের কয়েকজনের লাশ রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে পাওয়া গেলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি আরও অনেক বুদ্ধিজীবীদের। তাদের মেরে ফেলার প্রয়োজনীয়তা কী ছিল, সেটা নিয়ে বলতে গেলে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগের সাবেক সমাজ কল্যান মন্ত্রীর একটা সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ উল্লেখ করা যায়।
"যুদ্ধের পর পরই গান তৈরি হলো- 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' তারপর 'সবকটা জানালা খুলে দাও না' এই যে লিরিক্স যারা করছে, তাদের আসলে দেশপ্রেম ছিল, চিন্তা ছিল মানুষের। তার আগে কবিরা। কবিরা সেদিন আমাদের মতো যুবকদের চাবুক মেরে মেরে আন্দোলনে নিয়ে এসেছেন। দে হুইপিং অফ দ্যা পেন, ইন ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। ইন্সপায়ার্ড আস টু বি এ ফ্রিডম ফাইটার, টু বি এ ওয়ার্কিং মুভমেন্ট।
এটা এমনি আসেনি। সাহিত্যিকদের ইত্তেফাকে যেসব কবিতা আসতো! তারপরে দেখেন ৬৯ এর পর "বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ" রাজ্জাক, কবরী এরা যখন মাঠে নেমে গেল, রাস্তায় নেমে গেল, তখন হাজার মানুষের ঢল। এগুলো তো অল দিস কালচারাল মুভমেন্ট"।
সেদিন উনি এসেছিলেন একটা গানের অনুষ্ঠানে। সে কারণেই কালচারাল দিক নিয়েই কথা বলেছিলেন। কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে "কবিরা সেদিন আমাদের মতো যুবকদের চাবুক মেরে মেরে আন্দোলনে নামিয়েছে"। এই একটা কথাতেই সুস্পষ্ট ফুটে উঠে এই মানুষগুলোকে আমাদের নতুন জন্ম নেয়া মায়ের কতখানি দরকার ছিল। আর এই সোনার মানুষগুলোকে যদি মেরে ফেলা যায়, তাহলে আমাদের ভঙ্গুর দেশটা যে দাঁড়াতে পারবে না, এটা বুঝতে রকেট সাইন্সের দরকার পরে না। আর এ কারণেই খুঁজে খুঁজে আমাদের দেশ অন্তপ্রাণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসকদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এদিকে গত কয়েকবছর ধরেই এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা নিয়ে নানা ধরণের বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়ানো হচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন ছিল বিএনপির বাবু গায়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্য। গতবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে তিনি আবারো বিতর্ক উসকে দিয়ে বলেন "যারা পকিস্তানের বেতন খাইল, তারা হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা, আর যারা পালিয়ে না খেয়ে বেড়াল, তারা হয়ে গেল রাজাকার। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করা দরকার। কারণ এগুলো এখন ডাবল স্ট্রান্টার্ড হয়ে গেছে। একাত্তরে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা পাকিস্তানের বেতন ভাতা খেয়েছে তারা নির্বোধের মতো মারা গেল। আর আমাদের মতো নির্বোধেরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দিই। আবার না গেলে পাপ হয়। তারা যদি এতো বৃদ্ধিমান হয়, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকেন কীভাবে?"
এছাড়াও আর কিছু কটু যুক্তি অনেক বছর ধরেই ঘুরছে অনলাইন বা অফলাইনে। সেখানে বারবার বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় আওয়ামীলীগকেই দেয়া হচ্ছে। অভিযোগগুলোও এসেছে জামায়াতে ইসলামীর আস্থাভাজন ছাগু গোত্র থেকে। তাদের যুক্তিগুলো ছিল-
- পাকিস্তানি বা তাদের দোসররা বিজয়ের দুই দিন আগেই কেন হত্যা করলো, কেনই বা তার আগে করলো না?
- ঐ সময় তো প্রায় সব অঞ্চলই মুক্ত হয়ে গেল, তাহলে বিনা বাধায় কীভাবে হত্যা করলো রাজাকারেরা?
- পাকিস্তানি না হয় হত্যা করেছে, কিন্তু তাদের কেন রাজাকার, আলবদর সহযোগীতা করবে! সে সময় তাদের তো ভয়ে থাকার কথা বিজয় আসন্ন বলে।
- হত্যা করা সকল বুদ্ধিজীবী কেন চীনপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাসী, আওয়ামীপন্থী কেন নাই?
- পাকিস্তান কেনই বা এ দেশের সকল মেধা ধ্বংস করে দিয়ে এদেশকে ভারতের মেধায় চলার জন্য বাধ্য করবে?
এবং এই বিতর্কটার শুরু খুব সম্ভবত ২০০৩ সাল থেকে। সেবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এক স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন বুদ্ধিজীবী হত্যায় ফাঁসি প্রাপ্ত আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সেখানে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতের দায় উঠলে বলেন- " যারা বাংলাদেশের সীমানায় বিশ্বাস করে না, তারাই বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে জড়িত। জামায়েতে ইসলামী বাংলাদেশের সীমানায় বিশ্বাসী। সবাই জানে ভারতের সাথে কাদের মাখামাখি সম্পর্ক"
কথা প্রসঙ্গে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে একাত্মতা না করার প্রসঙ্গে বলেন, "শেখ মুজিব তাদের সাথে আলোচনা করেননি, তিনি কী করতে যাচ্ছেন, আমাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে শেখ মুজিব ইন্ডিয়ার সাথে যোগ দিবেন। আর তারা হিন্দুস্তানের সাথে যোগ দিবেন না বলেই বিরোধীতা করেন"। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার প্রসঙ্গে বলেন, "এত বছর আগের ঘটনা সেসময় বিচার করা হয়নি কেন? আপনারা জানেন বিচারে দেরি হলে সেটা ন্যায় বিচার হয় না। তাই এত বছর ধরে যেহেতু এই বিচার হয় নি আর এখন এর ন্যায় বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাই জামায়েতও এই দায়ভার থেকে মুক্ত। আর বুদ্ধিজীবী হত্যায় তাদের কোনো দায়ও নেই। কারণ হত্যা করেছে আওয়ামীলীগ নিজেই। (সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক)
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী কারা বা এর দায়ভারই কার?
'যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এ বারের উদ্ঘাটিত এ সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে, সে জন্য সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।'- মতিউর রহমান নিজামী (দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
উপরের কথাটার পর নিশ্চয়ই আর কোনো কিছু বলার দরকার পরে না বুদ্ধিজীবী হত্যার রক্ত কাদের হাতে। তবুও ঘুরে আসা যায় বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর সাক্ষ্যতে আবার।
পান্না কায়সার: যখন ওকে (শহীদুল্লাহ কায়সার) অন্ধকার ঘর থেকে টান দিয়ে আমার সঙ্গে বারান্দায় নিয়ে এলো, পেছন থেকে ওর হাতটা ধরে আমিও বারান্দায় গেলাম। গিয়ে তাড়াতাড়ি সুইচটা অন করে দিলাম। সব আলো হয়ে গেল। সবার মুখে মুখোশ। আমার ননদ পাশ থেকে দৌড়ে এলো। ও তখন সন্তানসম্ভবা। উপায়ান্তর না পেয়ে একজনের মুখের কাপড়টা টান দিয়ে খুলে ফেলল। সে-ই ছিল খালেক মজুমদার (এ বি এম খালেক মজুমদার)।'
শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছোট ভাই শমসের চৌধুরী: ওরা ভেতরে ঢুকে বেশ সমীহের সঙ্গেই ভাইকে বলল যে আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু ধানমন্ডি থানায় যেতে হবে। বড় ভাই একটু পেছনে হটে বলল, তোমাদের কথায় তো আমি যেতে পারি না। এ সময় একটি ছেলে ঘুরে এসে বন্দুকটা ওনার পিঠে ধরল। বলল, স্যার চলুন। বড় গেটের সঙ্গে একটা আয়রন গেট খোলা থাকে। সে গেট দিয়ে ভাই চলে যাচ্ছে। সে দৃশ্যটা আমার আজও মনে আছে। যাওয়ার সময় বলল, যাইরে ভাই। আমি বললাম, যা। এই তো। আজও গেল, তার দেহ পাওয়া যায়নি। সে কোথায় আছে, কেমন আছে, আমার ভাই, জানি না।
আসিফ মুনীর চৌধুরী তন্ময় (মুনীর চৌধুরীর ছেলে): ১৯৭২ সালে সে সময়ের পত্রিকা পূর্বদেশ দেখে আমার চাচা, মা, ভাই নিশ্চিত হন আল-বদর বাহিনীর অপরেশন-ইন-চার্জ চৌধুরী মুঈনউদ্দীন এবং চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান আমার বাবাসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ, গুম এবং পরবর্তীতে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। পত্রিকায় ছবি দেখে আমার রুশো কাকা চিনতে পারেন যে, ৩/৪ জন তরুণের মধ্যে এই দুইজন আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: ২৫ মার্চের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন প্রতিরোধের কাজে যুক্ত ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এবং সেখান থেকে ১৫ মে কলকাতায় স্পরিবারে যাই। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন গড়ার কাজে যুক্ত হই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসি। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোট ভাই অধ্যাপক লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর কাছে জানতে পারি, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর বাসা থেকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে কয়েকজন যুবক ধরে নিয়ে যান। ওই যুবকদের মুখে রুমাল বাঁধা ছিল।
একপর্যায়ে যুবকদের একজনের মুখের রুমাল খুলে গেলে মোফাজ্জল হায়দার তাঁকে বলেন, ‘মুঈনুদ্দীন, তুমি?’ তখন মুঈনুদ্দীন মুখে রুমাল বাঁধতে বাঁধতে বলেন, ‘জ্বি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। কোনো ভয় নেই। এই মুঈনুদ্দীন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র ও ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৬৯ সালে তাঁকে কিছুদিনের জন্য ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দুই শহীদ শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করি আমি। ওই সময় মোফাজ্জল হায়দারের স্ত্রী সৈয়দা মনোয়ারা চৌধুরী আমাকে বলেন, ‘আপনার ছাত্ররাই আপনার স্যারকে নিয়ে গেছে।’
এইখানে দেখা গেল কয়েকটা নাম সব কয়টা ভুক্তভোগী পরিবারের নিকট পরিচিত। এরা হলো আশরাফুজ্জামান, চৌধুরী মইনুদ্দিন ও বি এম খালেক মজুমদার। এরা কারা ছিল?
দেশ স্বাধীনের পর ঘাতক-দালালদের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে ছিল চৌধুরী মঈনউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। একজন বুদ্ধিজীবি হত্যার অপারেশন ইন চার্জ, অন্যজন জল্লাদ। আশরাফুজ্জামান ছিল জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় তার ভূমিকা ছিল চিফ একজিকিউশনারের। যে গাড়ি করে ঘাতকেরা বুদ্ধিজীবীদের রায়ের বাজারের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত, তার ড্রাইভার মফিজুদ্দিন ধরা পড়ার পর জবাববন্দীতে তার এই পরিচয়ই দেয়। দুজনে জামাতে ইসলামী অফিসের উল্টোদিকে থাকত। আশরাফুজ্জামানের ৩৫০ নম্বর নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। সেখানে দুটো পৃষ্টায় ২০জন বুদ্ধিজীবির নাম পাওয়া যায় যাদের মধ্যে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। তারা হলেন মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের , গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাক্তার গোলাম মুর্তজা। এদের প্রত্যেককে আশরাফুজ্জামান নিজে গুলি করে হত্যা করেছিল বলে জবানবন্দী দেয় মফিজুদ্দিন। ডায়েরির অন্যান্য পাতায় দালাল বুদ্বিজীবিদের নামের পাশাপাশি আল-বদরের হাই কমান্ডের নামের তালিকা ছিলো।
এতে মঈনউদ্দিন ছাড়াও ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড সদস্য শওকত ইমরান ও ঢাকা শহরপ্রধান শামসুল হকের নাম। ১৫ ডিসেম্বর রাতে চৌধুরী মইনুদ্দীন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত ও নেপাল হয়ে মঈনউদ্দিন পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানে হাজিরা দেয় গোলাম আযমের কাছে। পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে যায় সৌদি আরব। বাংলাদেশ নাস্তিক হয়ে গেছে, সেখানে সব মসজিদ এখন মন্দির- ইত্যাদি মিথ্যে দিয়ে সৌদির আনুগত্য লাভ করে। আর এই অনুগত্য ও অর্থ জোগাড়ে গোলাম আযম ছাড়াও তার সঙ্গী ছিল সিলেটের কুখ্যাত আল-বদর ঘাতক আবদুর রাজ্জাক এবং পাকিস্তান জামাতে ইসলামী নেতা মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল।
৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আর এই কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন হয় নি। তাই সেখান থেকে যুক্তরাজ্য চলে যান ও জামায়াতে ইসলামের জন্য অর্থ যোগান দিয়ে থাকে। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে ফক্স বাটারফিল্ডের লেখা ‘আ জার্নালিস্ট ইজ লিংকড টু দ্য মার্ডার অব বেঙ্গলিজ’ নামে একটি বিশেষ রিপোর্ট ছাপা হয়। এতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে মঈনউদ্দিনের সংশ্লিষ্ঠতার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমানে এই ঘাতক যুক্তরাজ্যে পলাতক রয়েছে এবং ২০১৩ সালে তার যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত।
এদিকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম এ বি এম খালেক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলামীর ঢাকা শহর শাখার দপ্তর সম্পাদক ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল সে। শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিল। খালেক মজুমদারকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। আদালতে আবারো শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী, বোন, ভাইয়েরা তাকে শনাক্ত করেন। বিচারে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করার দায়ে তার শাস্তি হয় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং আরও কিছু মামলা চলমান ছিল তার নামে।
কিন্তু তারপর ৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল হাইকোর্টের এক রায়ে খালেক মজুমদারকে ‘শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ মামলার অভিযোগ’ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে তার কারাগারের দিনগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন "শেকল পরার দিনগুলি" নামের। গত বছর পর্যন্ত বইটি বইমেলায় বিক্রি হয়েছিল বলে শোনা যায়। ২৫ জুলাই ২০১৪ সালে এই ঘাতক স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।
তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব মকবুল আহমাদ শোকবাণী প্রদান করে। শোকবানীতে তিনি বলেন "মরহুম জনাব এ.বি.এম আবদুল খালেক মজুমদার আল্লাহর দ্বীনের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। এ দেশে ইসলামী সমাজ কায়েম করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। মরহুমের জীবনের নেক আমলসমূহ কবুল করে তাকে জান্নাতবাসী করার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং তার শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আল্লাহ তাদের এ শোক সহ্য করার তাওফিক দান করুন।"
এবার বিচারের দায়ভার আপনাদের উপরেই। আপনারাই পুরোটা পড়ে ভেবে বলুন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় কার? এদের কি আওয়ামীলীগ হত্যা করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে, নাকি আমাদের দেশকে পঙ্গু বানিয়ে দিতে চেয়েছে আজীবন পাকিস্তানের পা চাটা জামায়াতে ইসলামি।
বড় এই লেখাটা শেষ করে দেই শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সারের সহধর্মিণী পান্না কায়সারের ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের মন ভাবনা দিয়ে...
"১৩ তারিখ রাতে আমাকে ও বলেছিল কাল সত্যি সত্যি চলে যাব। পথ থেকে ফিরে আসবে না। (সবার অনুরোধে তাকে ভারতে যাবার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল। ১৩ তারিখ সে বাড়ি থেকে বেড়িয়েও আবার ফিসে আসে)।
"মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনতাকে স্বাগত জানাচ্ছে সবাই হৃদয়ের পূর্ণ আবেগে। আমিও তো এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছি। করেছে আমার প্রিয় মানুষটি। এ দিনটির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে। আমি সেই প্রিয় মানুষটিকে খুঁজতে বেরিয়েছি"
সেই প্রিয় মানুষটিকে আজও খুঁজেন পান্না কায়সার। যে মানুষটি শেষবার একটা স্মিথ হাসি দিয়ে তাকে বলেছিল, "এবার আসি।"
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে- পান্না কায়সার
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের ছেলে জাহিদ সুমনের স্মৃতিচারন
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ট্রাইবুনালকে দেয়া সাক্ষ্য
তন্ময় চৌধুরীর বাবাকে নিয়ে স্মৃতি
দৈনিক ইত্তেফাক
দৈনিক ভোরের কাগজ
দৈনিক সংগ্রাম
জন্মযুদ্ধ ৭১- অমি রহমান পিয়াল
Featured Image Source: Jugantor