ইনিয়েস্তা, আপনাকে ছাড়া বার্সেলোনাকে শূন্য মনে হয় ভীষণ, ন্যু ক্যাম্পের বিশাল মাঠটা কেমন যেন খালি খালি লাগে, দলটাকে মনে হয় ছন্নছাড়া, বিবর্ণ!

আপনার বিদায়ের দিনটার কথা খুব মনে পড়ে। শূন্য মাঠে একাকী বসে আছেন আপনি, ঘাসের স্পর্শ গায়ে মেখে। ন্যু ক্যাম্পের এই মাঠটা আপনাকে তারকা বানিয়েছে, এখানে আপনি ফুটবলীয় সৌন্দর্য্যের চাষ করেছেন, জাভি আর মেসির সঙ্গে গড়েছেন ভয়ঙ্কর এক জুটি। ফ্লাডলাইটগুলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আঁধার নেমে আসছে সেই মাঠের বুকে, যেখানে আলো ছড়িয়েছেন আপনি। ক্যামেরাম্যানরা আর্টিস্টিক একটা ছবি তোলার জন্যে এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছান, মাঝখানটায় অবিচল, স্থির হয়ে বসেছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো, শরীরটা এখানে, কিন্ত মনটা পড়ে আছে অন্য কোথাও। 

একদিন তো সবাইকেই যেতে হয়। প্রকৃতির নিয়মেই বিদায় নিতে হয়, বিদায় জানাতে হয়। আমরা জানতাম, একদিন আপনি চলে যাবেন। আপনিও তো জানতেন, জানতো মিডিয়া। সেই মৌসুমটাই স্পেনে আপনার শেষ মৌসুম, মেরুন-নীল রঙের ডোরাকাটা জার্সি গায়ে সবুজ মাঠে আপনার স্থায়িত্ব আর অল্প ক'টা দিনের, সেসব আমরা জেনে গিয়েছিলাম আগেই। কিন্ত মানতে পারলাম কই? মনকে মানাতেই বা পারলাম কই? আপনি কি মানতে পেরেছেন ইনিয়েস্তা? যাবার বেলায় আপনার চোখে জল কেন তবে? মাইক্রোফোনের সামনে আপনার গলার স্বরটা এমন কেঁপে উঠেছিল কেন? 

এস্পানিওলের পাঁড় ভক্ত ছিলেন আপনি, তখন কি জানতেন, এস্পানিওল নয়, নগর প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আপনার নামটা! বার্সেলোনার সঙ্গে আপনার আত্মার সম্পর্ক, বার্সেলোনা আর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা তো মোটামুটি সমার্থক শব্দই! অথচ লা মাসিয়ায় আপনি থাকতে চাননি, কেঁদেকেটে বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন! এতগুলো বছর কেটে গেল, যাবার বেলায় অশ্রুর সংবরণ হলো কই? সেই তো কেঁদেই বিদায় নিলেন, কাঁদালেন সবাইকে!

বার্সেলোনাকে বিদায় বলছেন ইনিয়েস্তা

বারো বছর বয়সে বার্সেলোনার একাডেমিতে এসেছিলেন আপনি, তেত্রিশ বছর বয়সে ক্লাব ছাড়ছেন। একুশটা বছর ধরে আপনার ধমনীতে বইছে বার্সেলোনা নামের অন্যরকম একটা রক্তস্রোত। ন্যু ক্যাম্পের সেই গগণবিদারী চিৎকারগুলোর কথা এখন মনে পড়ে না আপনার? চ্যাম্পিয়ন্স লীগে চেলসির বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচ, শেষ মূহুর্তের গোলের পরে জার্সি খুলে সেই দৌড় দেয়ার ভিডিওটা মাঝেমধ্যেই দেখেন হয়তো আপনি, রোমন্থন করবেন ফেলে আসা দিনগুলো। মোর দ্যান এ ক্লাব- শ্লোগানটা কানে বাজে হুটহাট, তাই না? 

মূল দলের হয়ে ষোলটা মৌসুম, সাড়ে ছয়শোর বেশী ম্যাচ, একত্রিশটা ট্রফি, বত্রিশ নম্বরটা কড়া নাড়ছে দরজায়- এসব পরিসংখ্যান দিয়ে কি আপনাকে বিশ্লেষণ করা যাবে বলুন? আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে বুঝতে হলে ফুটবলটা বুঝতে হবে, ফুটবলকে ভালোবাসতে হবে। ইনিয়েস্তা মানে ফুটবল মাঠে সৌন্দর্য্যের পসরা। আপনার জার্সি নম্বর আট, ইংরেজীতে সেটা আবার ইনফিনিটির(অসীম) চিহ্ন। বার্সেলোনার জন্যে আপনার অবদানটাও তো এমনই অসীম! 

সমসাময়িক দুই গ্রেট ছিল আপনার, মেসি-রোনালদো। গোলের পর গোল করে গেছে ওরা, এখনও করছে, সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছে। অথচ লিওনেল মেসি নামের জাদুকরের সাফল্যের পেছনে আপনার অবদান তো কম কিছু নয়! বার্সেলোনার অজেয় হয়ে ওঠার পেছনে আপনার শ্রমটুকু কি সবার চোখে পড়ে? আপনি তো স্ট্রাইকার নন, আপনার কাজ বলের যোগান দেয়া। সেই দায়িত্বটা কি সূচারুভাবে পালন করেছেন আপনি, সেটার সাক্ষী আমরা। ডিফেন্সচেরা পাস, বুদ্ধিদীপ্ত থ্রু, টিকিটাকা নামের ফুটবলীয় ঘরানাটাকে এমন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দেয়ার পেছনে তো আপনার অসীম অবদান! 

জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপাই

গার্দিওলা-এনরিকে'রা পরিকল্পনা করেছেন, সেগুলো মাঠে বাস্তবায়ন করেছেন আপনি। প্রতিপক্ষকে ঘোল খাইয়েছেন, মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সতীর্থদের গোলে যোগান দিয়েছেন, গড়েছেন ব্যবধান। চেলসির বিপক্ষে সেই গোলটা এখনও চোখে ভাসে, সারাজীবন ভাসবে। ওই গোলটা না দিলে বার্সেলোনা ফাইনালে ওঠে না, শিরোপাটা জেতে না! হলুদ জার্সিটা খুলে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটলেন আপনি, স্বাগতিক স্টেডিয়ামটাকে শ্মশান বানিয়ে! আরও একবার এভাবেই ছুটেছিলেন আপনি, ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে। একটা গোলের দাম যে কত হতে পারে, সেটা স্পেন জানে, আপনি জানেন। হাঁটু গেঁড়ে বসে আপনার দুই হাত মুষ্ঠি করে তুলে ধরা, যেন দেবদূত আপনার রূপ ধরে নেমে এসেছিল মাঠে!

রোনালদিনহোকে দেখে বার্সেলোনার প্রেমে পড়া, মেসির জন্যে এই ক্লাবটাকে ভালোবাসা। আর আপনি? আপনি মুগ্ধতার আরেক নাম। আপনি ভীনগ্রহের কেউ নন, অতিমানবীয় কিছু নেই আপনার মধ্যে, আপনি জাদুকরও নন। আপনি ভ্যান গগ, কিংবা পিকাসো, অথবা কখনও ফুটবল মাঠের লিওনার্দো ভিঞ্চি। গোল বলটা আপনার পায়ে এসে আশ্রয় নেয়, বুটের ছোঁয়ায় তুলি হয়ে যায়, সবুজ ক্যানভাসের বুকে আঁকা হয় শৈল্পিক এক চিত্রপট। আমরা সেসবের সাক্ষী ছিলাম, আমরা ইনিয়েস্তার স্বর্ণসময়ের দর্শক ছিলাম!

আপনার সঙ্গে পরিচয়টা কোন এক মধ্যরাতে, টিভি সেটের সামনে বসে। ধীরে ধীরে আপনার প্রতি মুগ্ধতার জন্মের সময়টাও সেই দ্বিপ্রহরেই। সেইসব নিকষ কালো মধ্যরাত্রি সাক্ষী, আপনার মতো কেউ অতীতে ছিলেন না, আপনার মতো কেউ ভবিষ্যতেও আসবেন না। আপনি অদ্বিতীয়, আপনি অনন্য একজন, যিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মানও আদায় করে নেন অবলীলায়! জেজো আপনাকে নিয়ে একটা কার্টুন বানিয়েছিল বিদায়ের কিছুদিন আগে, আট নম্বর জার্সির আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছেন, পেছনে পড়ে আছে আপনার পায়ের কারুকাজে আঁকা আলপনা। আপনি বিদায় বলে দিয়েছেন বার্সেলোনাকে, চলে গেলেন, পেছনে পড়ে রইলো স্মৃতির ভাণ্ডার, পড়ে রইলো অজস্র ধ্রুপদী লড়াইয়ের গল্প, জেজো'র সেই কার্টুনটার মতো।

ইনিয়েস্তার শূন্যতা পূরণ হবার নয়

ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দিয়েছে, জীবনের এই ট্রেনে উঠে পড়েছে আপনি, খেলাটা পুরোপুরি আপনি এখন 'সাবেক ফুটবলার'। বার্সেলোনা থাকবে, মেরুন-নীলরঙা জার্সিতে প্রিয় এই দলটা খেলবে, মাঠে আপনি থাকবেন না, ড্রেসিংরুমে তোলা উইনিং সেলিব্রেশনের ছবিতে আপনার হাসিমুখটা দেখা যাবে না আর, বার্সেলোনা আরও অনেক ট্রফি জিতবে, জার্সি গায়ে সেই ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরবেন না আপনি। ইনিয়েস্তা, আপনাকে ছাড়া বার্সেলোনাকে শূন্য মনে হয় ভীষণ, ন্যু ক্যাম্পের বিশাল মাঠটা কেমন যেন খালি খালি লাগে! 

আপনি লা মাসিয়ার ছেলে, বার্সেলোনার সন্তান, আপনার শরীরে বার্সেলোনার রক্ত, যে রক্তস্রোত প্রতি সেকেন্ডে চিৎকার করে বলে- "মোর দ্যান এ ক্লাব!" জীবনানন্দ ধানশালিকের বেশে আবার ফিরতে চেয়েছিলেন এই বাংলায়; আপনিও নিশ্চয়ই ফিরবেন ন্যু ক্যাম্পে, অন্য কোন দিন, অন্য কোন ভূমিকায়। সেদিন আমরা হয়তো থাকবো, কিংবা থাকবো না; হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনাটা কিন্ত প্রতিমূহুর্তে আপনার সঙ্গে থাকবে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, কারণ আমাদের ডন আন্দ্রেস তো একজনই! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা