চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা ও ভারতীয় মিডিয়ার কমেডি সার্কাস
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
২৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। অথচ ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো ফলো করলে যে কারো মনে হবে, লাদাখের পথে-প্রান্তরে চীনা সেনারা বুঝি বেদম মার খাচ্ছে, অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেইজিং ফিরে যাচ্ছে...
লাদাখের বিরোধপূর্ণ গালোয়ান উপত্যকায় চীনা সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে তেইশ ভারতীয় সেনা, এর মধ্যে কর্নেল পদমর্যাদার এক অফিসারও আছেন। রক্তাক্ত এই ক্ষয়ক্ষতির জবাবে ভারত জানিয়েছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্মদিনে এবার নরেন্দ্র মোদি শুভেচ্ছা জানাবেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মোদির কাছ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা না পেলে বুঝি জিনপিংয়ের এবারের জন্মদিনটা মাটি হয়ে যাবে! ভারতীয় মিডিয়ার আচরণ দেখে অন্তত এমনটাই মনে হচ্ছে। অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি যে, মোদির এই সিদ্ধান্তটাকেই 'মাস্টারস্ট্রোক' হিসেবে বর্ণনা করছে কিছু টিভি চ্যানেল!
জি নিউজ, নিউজ এইটিন, নিউজ এক্স বা ইন্ডিয়া টিভির মতো চ্যানেলগুলো ফলো করলে যে কারো মনে হবে, চীন-ভারতের যুদ্ধ বুঝি শুরু হয়ে গেছে, লাদাখের পথে-প্রান্তরে চীনা সেনারা ভারতীয়দের হাতে বেদম মার খাচ্ছে, অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেইজিং ফিরে যাচ্ছে তারা। একেকদিন একেক রকমের অদ্ভুত সব থিওরি আর ফর্মূলা নিয়ে হাজির হচ্ছে চ্যানেলগুলো, ছাড়াচ্ছে গুজব, মানুষও দেখছে, টিআরপি পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে মিডিয়ার বড়সড় একটা অংশ।
নিউজ এইটিন আবিস্কার করেছে, যুদ্ধ শুরু হলে কেন চীন ভারতের কাছে পাত্তা পাবে না সেই রহস্যের। তাদের মতে, চীন হচ্ছে নাস্তিক রাষ্ট্র, কমিউনিজমের চর্চা হয় সেখানে। প্রতিটা ধর্মে দেশপ্রেমকে পূণ্যের কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে। চীনের মানুষ যেহেতু ধর্মই মানে না, তাদের জন্য পূণ্য অর্জনেরও কোন চ্যালেঞ্জ নেই। কাজেই তারা যুদ্ধে জীবন দিতে উৎসাহী হবে না। বরং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবে! এরকম গাঁজাখুরি যুক্তি যে একটা চ্যানেলের প্রাইম টাইমের উপস্থাপন গড়গড় করে বলে যেতে পারেন, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
ভারতে সবচেয়ে বায়াসড এবং গুজব রটনাকারী নিউজ চ্যানেলের তালিকা করলে সবার ওপরে থাকবে জি নিউজ। চীনকে হারানোয় তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? জি নিউজের এডিটর সুধীর চৌধুরী ফর্মূলা বের করেছে, ভারতের কাছে চীন শোচনীয়ভাবে হারবে, কারণ ১৯৮৯ সাল থেকে চীনে ওয়ান চাইল্ড পলিসি চালু করা হয়েছিল। চীনা সেনাবাহিনীতে যারা সৈন্য, তাদের বেশিরভাগই নাকি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। পারিবারিক দায়িত্বও যেহেতু তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে, তাই দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে তারা চাইবে না। আর তাদের এই দুর্বলতার সুযোগেই নাকি ভারত অনায়াসে হারিয়ে দেবে চীনকে!
জি নিউজ আরও বলেছে, চীনা আর্মি হচ্ছে ভিডিও গেমের সৈন্যদের মতো। কিংবা পাবজি গেমের কাল্পনিক যোদ্ধা, যাদেরকে গুলি করে উড়িয়ে দেয়া কোন ব্যাপারই না। চীনের সেনারা যদি এতই হেলাফেলা করার মতো হয়, তেইশ জন সৈন্য নিহত হবার পরেও ভারত কেন জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছে, সেটা বোধগম্য হচ্ছে না। কয়েকটা চ্যানেল আবার কূটনীতির বদলে খুনের নীতিতে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছে সরকারকে। এদের কাছে যুদ্ধটাকে ডব্লিউ ডব্লিউ ই- এর রেসলিং ম্যাচ মনে হয় কিনা কে জানে!
অর্ণব গোস্বামীকে একসময় ভারতের এক নম্বর সাংবাদিক ধরা হতো। ঘাঘু পলিটিশিয়ানদের নিজের শো-তে ডেকে চেপে ধরতেন। কালের বিবর্তনে তিনি নাম লিখিয়েছেন তেলবাজদের দলে, তার টক-শো মানেই এখন কমেডি সার্কাস। নিজের টক-শোতে তিনি প্রতিদিন চীনকে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন, শি জিনপিংয়ের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছেন, চীনাদের মতো দেখতে এক হিন্দিভাষীকে ডেকে এনে কথা শোনাচ্ছেন। চ্যানেলের স্ক্রলে প্রশ্ন করা হচ্ছে, ভারতের কি উচিত চীনের ওপর আক্রমণ করা? হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে জানান। যেন ইন্ডিয়ান আর্মির জেনারেলরা বসে এই শো দেখছেন, হ্যাঁ ভোট বেশি পড়লেই সৈন্যদের আদেশ দেবেন, ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বিমান ছুটে যাবে চীন সীমান্তে! অদ্ভুত সব কৌতুক চলছে টিভির পর্দাজুড়ে!
ভারতের মিডিয়া গত ৫/৬ বছরে বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে পুরোপুরি। তাদের মুখে নরেন্দ্র মোদির তারিফ ছাড়া আর কিছুই শুনবেন না। এই স্রোতে ব্যতিক্রম বলতে গেলে এক এনডিটিভি। সেই চ্যানেলের সাংবাদিক এবং র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড জয়ী রবীশ কুমার এসব মিডিয়ার নাম দিয়েছিলেন গদি মিডিয়া। গদিতে, অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা দল আর নেতাদের তোয়াজ করাটাই যাদের কাজ। যারা সরকারের দিকে প্রশ্ন না তুলে উল্টো বিরোধী দল আর জনগনের দিকে আঙুল তোলে। হাস্যকর সব যুক্তি দিয়ে সরকারের ভুল কাজগুলোকেও হালাল করার চেষ্টা করে। সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা সঞ্চার করে। ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পেছনে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অবদান কম নয়।
সারাবছর পাকিস্তানের বিপক্ষে কাল্পনিক যুদ্ধ করতে করতে ভারতের মিডিয়া চীনকেও পাকিস্তানের মতো দুর্বল প্রতিপক্ষ ভাবছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দিয়ে টিআরপি কামানোর নেশায় মেতেছে। এদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, ইন্ডিয়ান আর্মি নয়, সিনেমার পর্দা থেকে বেরিয়ে সানি দেওল, ববি দেওল, সুনীল।শেঠী আর সঞ্জয় দত্তরা বুঝি লাদাখে ছুটে যাবেন, প্রত্যেকে একাই হাজার হাজার চীনা সৈন্যকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে ওড়াবেন ভারতের তেরঙা পতাকা। পেছনে বাজবে সিনেমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক!
ভারতের মিডিয়ার অবস্থা দেখে নিজের দেশের মিডিয়া আর টিভি চ্যানেলগুলোকে ফেরেশতা বলে মনে হয়। এমন বানোয়াট আর মনগড়া যুক্তি-তর্ক শোনার চেয়ে বরং মাহফুজুর রহমানের গান রিপিট মুডে শোনাও ভালো...
আরও পড়ুন- চীন-ভারত সংঘর্ষ: নেপথ্যের কারণ কি?