১৪৫০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি হবে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার একদিন পরেই ভারত আমাদের দেশে পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করে দিলো কোন আগাম ঘোষণা না দিয়েই! আর তাতেই এক রাতে চল্লিশ টাকার পেঁয়াজের দাম হয়ে গেছে নব্বই টাকা...
আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। আগাম কোন ঘোষণা দেয়া ছিল না যে অমুক তারিখ থেকে রপ্তানি বন্ধ করা হবে, সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছে খানিকটা আচমকাই। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের পাইকারি এবং খুচরা বাজারে। গতকাল যে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি চল্লিশ টাকা, সেটাই এক রাতের ব্যবধানে নব্বইয়ে গিয়ে উঠেছে। তড়িৎ ব্যবস্থা না নিলে যে শ-দেড়শোর কোটা ছাড়াবে, কিংবা গত বছরের মতো আড়াইশো টাকাতেও উঠে যাবে- সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর আগেরবার যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন দুশো টাকা কেজি দিয়ে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। সিন্ডিকেট গড়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তির মুখে ফেলেছিল সবাইকে।
দূর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতে ১৪৫০ টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ১৩ই সেপ্টেম্বর। আর ঠিক পরদিনই ভারত সরকার সেদেশ থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বেনাপোল, ভোমরা বা হিলি সীমান্ত দিয়ে পেঁয়াজের কোন ট্রাকই গতকাল থেকে প্রবেশ করেনি বাংলাদেশে। পেট্রাপোল সীমান্তে (বেনাপোলের ভারতীয় অংশ) পেঁয়াজভর্তি কয়েকশো ট্রাক আগের রাতে এসে হাজির হয়েছিল, এখন সেগুলোকেও ফেরত যেতে হবে। পুরো ঘটনাক্রমে সবারই জানার আগ্রহ, কেন আচমকা পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলো ভারত?
প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা
ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর দেশটি প্রায় ২০ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে। রপ্তানি বন্ধের জন্য সরকারীভাবে নির্দিষ্ট কোন কারণ জানানো না হলেও, মূলত ভারতের আভ্যন্তরীন বাজারে পেঁয়াজের সংকট এবং দামের ঊর্ধ্বগামীতার কারণেই রপ্তানি বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার। মূল ক্ষতিটা করেছে প্রাকৃতিক বৈরীতা এবং করোনাভাইরাসের লকডাউন। কিছুদিন আগে প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে গেছিল কর্ণাটক। সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে খেতের পেঁয়াজ। চাষীরা মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন, যে পরিমাণ উৎপাদন হবার কথা ছিল সেটা হয়নি। ভারতেই এখন খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ষাট রূপির ওপরে, রপ্তানীকারকদের পক্ষে তাই কম দামে বাংলাদেশে পেঁয়াজ পাঠানো সম্ভব নয়।
গুজরাট আর মধ্যপ্রদেশে ঘটেছে অন্য ঘটনা, প্রবল বৃষ্টিতে সেখানে মাঠের পেঁয়াজের ক্ষতি তো হয়েছেই, জমে থাকা পানির কারনে অনেক গুদামের পেঁয়াজও নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণটা কয়েক হাজার কোটি টাকার কম নয়। সেই ধাক্কা সামাল দিতে মহারাষ্ট্র থেকে পেঁয়াজ পাঠানো হচ্ছে এসব রাজ্যে। ভারতে সবচেয়ে বেশি পেঁয়ার উৎপন্ন হয় মহারাষ্ট্রে, সেখানেও পেঁয়াজের বাজারে এখন আগুন, স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ দাম হাঁকাচ্ছেন পাইকারেরা।
করোনাভাইরাস ও লকডাউন
আরেকটা ক্ষতি করেছে করোনাভাইরাস। প্রায় আড়াই-তিন মাসের লকডাউনের কবলে পড়ে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পেঁয়াজের। লকডাউনের সময় মাঠে ফসলের কাজ করার লোক ছিল না। ফলে উৎপাদন অনেক কম হয়েছে। যা হয়েছে, সেটাও ঠিকভাবে বাজারে নিয়ে আসা যায়নি। পরিবহন ব্যবস্থার সংকট ছিল, কাজ করার জন্য মজদুর পাওয়া যায়নি। আর তাই খেতের ফসল খেতেই নষ্ট হয়ে গেছে- এমন ঘটনাও ঘটেছে।
বিহারের বন্যা ও নির্বাচন
এদিকে বিহারে বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সামনে আবার সেই রাজ্যে নির্বাচন আসছে। কেন্দ্র সরকারে থাকা বিজেপি সেই নির্বাচনে জোট বেঁধে জিততে মরিয়া। আর তাই এই রাজ্যের মানুষের মধ্যে কোন রকমের অসন্তোষ তৈরি হোক- এটা তারা চায় না। আর এক মাস বাজারের এই অবস্থা চললে পেঁয়াজের দাম আশি-একশো রূপিতে পৌঁছে যেতো, তখন সেটাকে ইস্যু বানিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পেতো বিরোধীরা। তাই মোটামুটি ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিয়েই বিহারে পেঁয়াজ পাঠাচ্ছে সরকার, অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পিছিয়ে থাকা এই রাজ্যটা। কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ বা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও ট্রাকে ট্রাকে পেঁয়াজ ঢুকছে বিহারে। একারণেও তৈরি হয়েছে সংকটের।
মহারাষ্ট্রে প্রতিবাদ
তবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়ে এসেছে কৃষকদের জন্য। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের কৃষকেরা, যারা পেঁয়াজের ভালো দাম পাবার আশায় বসেছিলেন। পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকেই মহারাষ্ট্রে রাস্তা অবরোধ শুরু করছেন কৃষক নেতারা। রপ্তানি বন্ধ হলে কৃষকদের ক্ষতি। তাঁরা বেশি দামে রপ্তানি করতে পারতেন। এখন কম দামে দেশের বাজারে পেঁয়াজ দিতে হবে, যেটা তারা মানতে রাজী নন।
অনেকেই বলছেন, ভারত সরকারের উচিত ছিল সরকারি কৃষি বিপনন সংস্থার হাতে থাকা পেঁয়াজগুলো বাজারে ছাড়া। সেই সঙ্গে পেঁয়াজের মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। তাহলেই বাজারে পেঁয়াজ আসত। দামও কম থাকত। সেটা না করে, সহজ পন্থা নিয়ে রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল তারা, যেটা ভারতের কৃষক এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জনগনের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কৃষকদের প্রতিবাদের নেপথ্যে আরেকটা সমীকরণ আছে এখানে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে সেই বাজারটা দখল করবে পাকিস্তান। কারণ এই অঞ্চলে ভারতের পর পাকিস্তানই সবচেয়ে বেশি পেঁয়ার রপ্তানি করে। গতবছর যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে উপমহাদেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, তখন পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানী করেই চাহিদার একাংশ পূরণ করেছিল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভূটানের মতো দেশগুলো
বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সবশেষ ভারত সফরেও পেঁয়াজ নিয়ে কথা বলেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন,।তারা পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে যেন আগে থেকে জানায়। নইলে বাংলাদেশের মানুষ বিপদে পড়ে। কিন্ত বরাবরই নিজেদেরকে 'বাংলাদেশের বন্ধু' দাবী করে আসা ভারত সরকার বাংলাদেশের সরকার প্রধানের এই অনুরোধ রাখলো না। এখন বাংলাদেশকে পেঁয়াজের জন্য হাত বাড়াতে হবে পাকিস্তান, মিশর বা তুরস্কের মতো দেশগুলোর দিকে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বিকল্প মার্কেট হিসেবে অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুরস্ক, চীন, মিয়ানমার, মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য যোগাযোগ করেছে সরকার। তুরস্ক থেকে আগামী চার পাঁচ মাসের মধ্যে টিসিবির মাধ্যমে এক লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। এছাড়া টিসিবি ন্যায্য মূল্যে ট্রাক সেল শুরু করে দিয়েছে। মন্ত্রীর দাবী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে, যদিও পেঁয়াজের বাজারের লাগামছাড়া অবস্থাটা তার বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে, এই মাস শেষে তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ চলে আসবে। ধাপে ধাপে ১০ দিন পর পর তিন চার হাজার টন করে আসবে- এমনটাও বলেছেন টিপু মুনশি।
ভারত যেটা করেছে, সেটা হয়তো নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যেই করেছে, কিন্ত সত্যিকার অর্থে এটা কোন বন্ধুরাষ্ট্রের আচরণ হতে পারে না। কোন পূর্বঘোষণা না দিয়ে আচমকা এভাবে রপ্তানি বন্ধ করে কোটি কোটি মানুষকে বিপদের মুখে ফেলাটাও কোন বন্ধুর কাজ হতে পারে না...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন