খাদের কিনারে দাঁড়ানো কোনো দলের এমন চোয়ালবদ্ধ লড়াইয়ে জয় দেখে কিছুক্ষণের জন্য রাইভালিটি ভুলে যেতে হয়। হ্যাটস অফ ইন্ডিয়া। কামব্যাক কতটা রঙিন হলে ৩৬ রানে অলআউটকেও এচিভমেন্ট বানিয়ে ফেলা যায়!

আগামী কয়েক মাস ক্রিকেট দেখব না (বাংলাদেশের সিরিজসহ) প্রতিজ্ঞা করার প্রথম দিনেই মুগ্ধ হয়ে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের শেষ দিনের অর্ধেক খেলা দেখে ফেললাম।

বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দলের খেলায় কখনো এতটা দম বন্ধ লাগেনি৷ টি-টুয়েন্টি, ওয়ানডে, লীগ...কোথাও না। আজকে টেস্ট খেলা দেখলাম রুদ্ধশ্বাসে।

অবিশ্বাস্য, স্রেফ অবিশ্বাস্য! ক্রিকেটের রেকর্ডে হয়তো এই ম্যাচে কেবল ভারতের তিন উইকেটের জয় দেখাবে, দেখাবে ভারত ২-১ এ সিরিজ জিতেছে। এই রেজাল্ট চেক করে বহু বছর পরের ক্রিকেটপ্রেমীরা আসলে কি বুঝবে এই সিরিজ কেমন ছিল?

৩৬ রানে অলআউট দল, প্রথম টেস্টের পর সেরা ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক মিসিং। অজি সাবেকরা তো ৪-০ এর বাইরে কিছু ভাবতেই পারছিল না।

দ্বিতীয় টেস্টে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ভারতের। ৩৬ রানে প্যাকড হওয়ার পর অধিনায়ক হারিয়ে ৮ উইকেটে কেউ জেতে? হয়তো না। তবে মিরাকল তো ঘটতেই পারে। মেনে নেয়া গেল।

তৃতীয় টেস্টে মাঠে নামার পর একে একে প্রায় অর্ধেক প্লেয়ার ইঞ্জুরড হয়ে গেল৷ শেষ ইনিংসে চেজ করতে হবে চারশোর বেশি। টেস্টের এই আধুনিক সময়েও কেউ চারশো চেজ করার সাহস করে না৷ বিদেশের মাটিতে তো অবশ্যই না। তার উপর দলের দুইজন হাসপাতাল ঘুরে এসেছে। আরো একজন হ্যামস্ট্রিং এ ভুগছে, অন্যজন নুয়ে প্যাড বাঁধতেই পারে না।

ভারত সেই টেস্টেও চেজ করার সাহস দেখাল। শেষ পর্যন্ত পারেনি অবশ্য। সেই ব্যর্থতা লেখা হয়েছে সাফল্যের চেয়েও উজ্জ্বল কালিতে। নিজের হাতে পানি তুলে খেতে না পারা পান্টের ১১৮ বলে ৯৭ এর পর আরো দুইজন ইঞ্জুরড ক্রিকেটার বিহারি-অশ্বিন ম্যাচ বাঁচিয়েছে আড়াইশ বলের চেয়েও বেশি খেলে! ও হ্যাঁ, ব্যাট প্যাড সাজিয়ে পরের উইকেটে নামার জন্য অপেক্ষা জাদেজা ব্যাট হাত দিয়ে ধরত নাকি পা দিয়ে, কে জানে!

শেষ টেস্টে ভারত নামল। একাদশে প্রথম টেস্ট খেলা ক্রিকেটার আছে মাত্র দুজন। ক্রিকইনফোর এনালিস্টরা ব্যস্ত হয়ে ডাটা খুঁজে গত একশ বছরে এমন কবে ঘটেছিল।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ব্যাক টু ব্যাক সিরিজ জিতলো ভারত

ভারতের বোলিং এট্যাকের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলারের টেস্ট ক্যারিয়ারের বয়স দুই ম্যাচ। ক্রিকইনফো আবার ঘাটাঘাটি করে। ভারতের সব বোলার মিলে উইকেট পেয়েছে মাত্র ১৩ টা। রেকর্ড। দুই দলের বোলারদের উইকেটের ব্যবধান এক হাজারের বেশি। ক্রিকইনফোর এনালিস্টদের বিশ্রাম নেই। এত এত অবিশ্বাস্য ঘটনার খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে!

এরগুলো ইঞ্জুরি শেষে কোনোমতে একাদশ সেট করে মাঠে নামার পর সাইনিও পড়ল ইঞ্জুরিতে। তাকেও স্ক্যান করানো হলো। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৬ নাম্বার উইকেট যখন পড়ে, তখনো তারা অজিদের অর্ধেক রান করতে পারেনি।

নবাগত বোলার ওয়াশিংটন সুন্দর ও শারদুল ঠাকুর একশ রানের জুটি দিয়ে দেবে জানত কেউ? তারা কাজ চালানোর মতো ব্যাটিং জানে ঠিক আছে। কিন্তু অজিদের মাঠিতে এই সময়ের সেরা চার বোলারের বিপক্ষে এবং বৃষ্টির মতো স্লেজিং এর মধ্যে দুইজনের এক সাথে ক্লিক করার সম্ভাবনা কতটুকু ছিল?

১৩ উইকেট অভিজ্ঞ ভারতীয় বোলাররাই অজিদের পুরো ২০ উইকেট নিয়ে নিল। ক্রিকইনফো জানাল লাস্ট ৪০ বছরে ব্রিজবেনে এই ঘটনা ঘটেছে মাত্র দুইবার। ভাবা যায়?

তারপর সিরিজের লাস্ট ইনিংস। শেষ দিনের লাঞ্চের সময় উইন প্রেডিক্টরের পেছনে বসে থাকা এক্সপার্টরা মত দিয়েছিলেন ম্যাচে ভারতের জেতার সম্ভাবনা ১%। ১% আসলে কোনো সম্ভাবনা না, এটা ক্রিকেটীয় ভদ্রতামাত্র। এর মানে হলো এই দলের জেতার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। তবে ক্রিকেট যেহেতু কথিত গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা এবং একটা দল কষ্ট করে খেলছে, তাই আমরা ১% দিলাম। বলাই বাহুল্য, ১% জয় প্রেডিক্ট নিয়ে কেউ কোনোদিন ক্রিকেট ম্যাচ জেতেনি।

মাত্র ১% সম্ভাবনা নিয়ে ম্যাচটা জিতেছে ভার‍ত, জিতেছে সিরিজও!

১% সম্ভাবনা টি ব্রেকের ১০ ওভার পরে হয়ে গেল ৬০%। সাড়ে তিন ওভার হাতে রেখেই জিতে গেল ভারত। কতটা অবিশ্বাস্য আসলে এই ব্যাপারটা!

ভারতের জয়ে "অবিশ্বাস্য" শব্দটা বারবার ব্যবহার করলে তাদেরকে সত্যি বলতে কিছুটা খাটো করা হয়ে যায়। শেষ এক ওভারে পান্টের অস্থিরতা বাদ দিলে পুরো ইনিংস একদম স্ক্রিপ্টের মতোই নিঁখুত। শরীরে ১১ টা বাউন্সার নিয়ে পুজারা উইকেট আগলে রেখেছেন। প্রায় একশ বলঅব্দি স্ট্রাইকরেট ছিল ১০ এর নিচে। সময়ের সাথে সাথে হাত খুলেছেন। অন্য পাশে তরুণ গিল সচল রেখেছেন রানের চাকা।

রাহানের ছোট্ট ইনিংসটা ছিল ঘোষণার মতো, অজিদের বিরুদ্ধে জ্যের ঘোষণা। তারপর পান্ট৷ অনেকেই আশা করেছিল রাহানের পর পান্ট এসেই মার শুরু করবে। অসাধারণ ম্যাচিউরিটি দেখিয়ে সে প্রথমে তাড়াহুড়ো না করে সেট হলো। ধীরে ধীরে ফিরল স্বরূপে। শেষের দুই ওভার ছাড়া একবারের জন্যেও মনে হয়নি ভারত তাড়াহুড়ো করছে। আবার কখনোই তারা ম্যাচের বাইরেও ছিল না।

টেস্ট ক্রিকেট বেশিরভাগ মানুষ দেখেন না। যারা দেখেন তাদের বেশিরভাগই আবার ভারতকে পছন্দ করেন না। আমার যে ফ্রেন্ড ফলোয়ার লিস্ট তাতে এই লেখাটা নিউজফিডে ছুঁড়ে দেয়া এক হিসেবে অনর্থক।

আসলে এটা লিখছি নিজের জন্যই। বছর ঘুরে মেমোরিতে আসলে লেখাটা পড়ব। টেস্ট ক্রিকেটের এক এপিক লড়াইয়ে ভারতের বীরত্ব মনে করব। ভারত ক্রিকেট টিমের প্রতি একটা তীব্র রাইভালিটি কাজ করে, গত ৬ বছরে ভারতের জয় কামনা করেছি কিনা মনে পড়ে না। তবে আজকের এই ম্যাচ ও সিরিজ জয়ের হিসেব ভিন্ন।

বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির এই সিরিজ ভারত একা জিতেনি। এখানে ভারতের চেয়েও বেশি জিতেছে ক্রিকেট। খাদের কিনারে দাঁড়ানো কোনো দলের এমন চোয়ালবদ্ধ লড়াইয়ে জয় দেখে কিছুক্ষণের জন্য রাইভালিটি ভুলে যেতে হয়।

হ্যাটস অফ ইন্ডিয়া। কামব্যাক কতটা রঙিন হলে ৩৬ রানে অলআউটকেও এচিভমেন্ট বানিয়ে ফেলা যায়! বহুদিন পর... বহু ভারতীয় ক্রিকেট ফ্যানের গালি খাওয়া শেষে আজকের জন্য আমি ইন্ডিয়া সাপোর্টার।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা