ভ্লগার এবং ইউটিউবার নাস ডেইলি জানাচ্ছেন সহজ কিছু পদ্ধতি!
গোলমেলে একটা অবস্থায় পড়েছি৷ স্কুলের বন্ধুদের সাথে রিইউনিয়ন হবে৷ স্কুলে আমাদের পছন্দের রেস্টুরেন্ট ছিল একটা, মতিঝিলের স্পাইসি পিকল৷ কিন্তু, এতোদিনে দুনিয়ার আরো অনেক কিছু দেখেছে, ধানমন্ডি, বেইলি রোড, খিলগাঁও, মিরপুরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে চেকইন দেয়া শেষ। তাই এখন সবার পছন্দও পালটে গেছে। যখন কথা উঠলো, আমরা কোথায় বসবো, অনেক চয়েজ আমাদের সামনে। একেকজন একেকটা জায়গার নাম বলছিল৷ আমরা পড়ে গেলাম সিদ্ধান্তহীনতায়। কি করবো, কোন জায়গায় বসলে কারো কোনো আপত্তি থাকবে না সেটাই হয়ে গেল মাথাব্যাথার বড় কারণ।
অথচ, আমরা ভুলেই যাচ্ছিলাম, রেস্টুরেন্ট বড় ব্যাপার নয়, আমাদের রিইউনিয়ন হচ্ছে সেটাই আসল ব্যাপার। মূল ফোকাস থেকে সরে যাচ্ছিলাম কারণ এখন আমাদের হাতে অনেক চয়েজ। যাইহোক, কোনোরকম একটা জায়গা ঠিক হলো৷ এখন মাথায় নতুন চিন্তা। কোন পোষাকটা পরা উচিত, পাঞ্জাবি নাকি টিশার্ট নাকি শার্ট, জিন্স। আবারো সিদ্ধান্তহীনতা। কোন পোষাক পড়লে কে কি ভাববে, মেয়েরা আসবে, তাদেরও ইম্প্রেস করার ব্যাপার আছে, কত উদ্ভট ভাবনা। কারণ, হাতে অনেক চয়েজ, তাই এরকম সিদ্ধান্তহীনতা।
যেদিন সবাই একত্রিত হলাম, সাময়িক উচ্ছ্বাস, সেলফি উৎসব করে ফেসবুকে উই আর অলওয়েজ ফ্যামিলি টাইপ ক্যাপশন লিখা শেষে খাবার কি খাওয়া হবে তা নিয়ে আরেকদফা বিতর্ক। কেউ সেট ম্যানু পছন্দ করে, কেউ সাব, কেউ বার্গার, অনেক রকম অপশন, অনেক রকম দ্বন্দ্ব। এটাও যখন ফিক্সড হলো আমরা আবারো কিছু সময় খরচ করলাম আরো একটা সিদ্ধান্ত নিতে, ড্রিংকস কোনটা খাবো ফান্টা, কোকাকোলা না সেভেন আপ সেই বিষয়ে। এটা সামান্য একটা উদাহরণ, আমরা ব্যাক্তিজীবনে এমন অনেক সময় নষ্ট করি সবচেয়ে সহজ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে।
এই যুগে এসে আমাদের হাতে অনেক অপশন। ফলে আমরা নিজেরা কি সিদ্ধান্ত নিবো সেটা চিন্তা করতেই একটা বড় সময় নষ্ট হয়। খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার রোজকার জীবনে সিদ্ধান্তগুলোই কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলে। কারণ, আমাদের প্রতিদিন কত শত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তার কোনো হিসাব নেই। যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক বেশি ভাবি, সেই সিদ্ধান্তগুলোর কনসিকুয়েন্স নিয়েও আমাদের অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে, আমরা অকারণে রেগে যাই, স্ট্রেস বেড়ে যায়, হতাশ হতাশ লাগে, নিজের উপর বিরক্ত লাগে। কারণ কি? কিছুই না, ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া নয়ত কোনো সিদ্ধান্ত নিবো কি নিবো না সেই দোটানায় ভুগতে ভুগতে এই সমস্যাগুলো হয় আমাদের।
কিভাবে এই সমস্যা থেকে বাঁচা যায়? ফেসবুকে প্রতিদিন এক মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করা নাস ডেইলি সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি ভিডিও বানিয়েছেন। এই সমস্যাটার নাম ইংরেজিতে "ডিসিশন ফ্যাটিগ (Decision Fatigue)"। নাস ডেইলি নিজেও এই সমস্যায় ভুগেন। সব মানুষের মধ্যেই এই সমস্যাটা আছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগার এই সমস্যা দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দেয়। আপনি কোথায় ঘুরতে যাবেন, কোথায় চাকরি করবেন, ভবিষ্যতে কি হবেন, কাকে জীবনসঙ্গী বানাবেন, যে ব্যবসাটা করবেন সেটা কি করতে পারবেন কিনা- কত ধরণের প্রশ্ন আপনার মাথায় ঘুরতে থাকে। ব্যাক্তিজীবনেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রতিদিন আপনাকে।
এগুলো থেকে বাঁচার উপায় কি? নাস ডেইলির মতো সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত হলো, সিদ্ধান্তই না নেয়া। হাজার হাজার সিদ্ধান্তের জালে পা না দিয়ে একটা সিদ্ধান্তই নেয়া এবং সেটাকে ঠিকঠাকভাবে ফলো করা। আর ব্যাক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার চাপ কিভাবে কমিয়ে আনা যায়? নাস ডেইলি ডিসিশন ফ্যাটিগ থেকে বাঁচতে কিছু ফর্মূলা ব্যবহার করেন। যেমন - পোষাক কি পরবেন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে এখন আর ঝামেলায় পড়তে হয়না। একই রকম টিশার্ট অনেকগুলো বানিয়ে রেখেছেন, সেগুলোই পড়েন সবসময়, সবজায়গায়৷ কি খাবেন সেই দুশ্চিন্তা না নিয়ে সিম্পলি রেস্টুরেন্টের ওয়েটারকে তার হয়ে অর্ডার করতে বলে দেন। গার্লফ্রেন্ডের প্রশ্নের উত্তর দেয়া কমিয়ে সিদ্ধান্তগুলো তার হাতেই ছেড়ে দেন। এভাবে ব্যাক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তগুলো থেকে তিনি ভারমুক্ত হন৷
সিদ্ধান্তহীনতাকে খুব হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনেক তুচ্ছ সিদ্ধান্তও মানুষ নিতে পারে না বলে সুইসাইড পর্যন্ত করে ফেলে৷ সিদ্ধান্তহীনতায় একবার ভুগতে শুরু করলে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েই আপনি তুষ্ট হবেন না। সব কিছুতেই আপনার ভয় হবে, আপনি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো এই ভেবে৷ তাই নিজের উপর সিদ্ধান্তের ভার কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারলে জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে। কয়েকটি কাজের মাধ্যমে আপনার দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য সিদ্ধান্তের চাপ নেয়া থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারেন।
১। আজকের দিনে কি কি কাজ করবেন, প্রত্যেকটা ঘন্টার কার্যতালিকা করে ফেলুন। কাগজে লিখে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল, এই তালিকা অনুযায়ী একটা একটা করে যদি কাজ শেষ করে ফেলতে পারেন, দেখবেন একসাথে অনেকগুলো কাজ করা হয়ে যাচ্ছে। আজকে কি করবেন এটা যদি আপনার জানা থাকে তাহলে আজকের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া আপনার জন্য সহজ। দিনের ঝামেলা দিনেই চুকে ফেলা ভাল৷
২। নিজের জন্য রিমাইন্ডার সেট করে ফেলুন মোবাইলে। একটা ওয়ালপেপার বানাতে পারেন, সেখানে লেখা থাকবে আপনার প্রতিদিনের ব্যাসিক যে কাজগুলো করা লাগবে তার কথা। যেমন - সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ একটা মর্নিং ওয়াকে যাবেন, তারপর বই পড়বেন, এরপর বিকেলে জিমে যাবেন, তারপর যে কাজটা ভালবাসেন যেমন গিটার বাজানো, লেখা, আকাঁ ইত্যাদি সেই কাজটা একঘন্টা প্র্যাক্টিস করবেন। এরকম রেগুলার কাজের একটা রিমাইন্ডার ছবি ওয়ালপেপারে দিয়ে রাখতে পারেন। এগুলো মানার জন্য আপনাকে কেউ বাধ্য করবে না। কিন্তু, যদি নিজের তাগিদেই করতে পারেন বাকি সিদ্ধান্তগুলো নিতে আপনার সুবিধা হবে। কারণ, আপনি জানেন আপনার প্রায়োরিটি লিস্ট কি।
৩। কি খাবেন এটা নিয়ে প্রতিদিন ভাবতে যাবেন না। উইকেন্ডেই ঠিক করবেন কি খেতে চান, কোথায় খেতে চান। সেই অনুযায়ী বাজার করে ফেলবেন। খাবার নিয়েও যদি অনেক ভাবতে হয় দেখা যাবে খাবার মনমতো না হলেই সেইদিনটাই আপনার খারাপ যাবে। এভাবে ছোটখাটো সিদ্ধান্তগুলোর দ্বারাও আপনি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারেন৷
৪। যখন আপনার কাজের সময়, তখন সবধরণের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমরা কাজ করি, হঠাৎ করে মেসেঞ্জারের শব্দ হয়, মেসেজ দেখি, এরপর আমরা ভুলে যাই কাজের কথা। আবার যখন কাজে ফিরে আসি ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে না। ইমেইল, মেসেঞ্জার, ইউটিউব সহ বিভিন্ন এপসের নোটিফিকেশন আমাদের অনেক প্রভাবিত করে। একটা নোটিফিকেশনে ডুবে গেলেই অনেক সিদ্ধান্ত ওলটপালট হয়ে যায়। মনযোগ নষ্ট হয়ে যায়৷
৫। কোনো অভ্যাস তৈরি করতে হলে ডিসিশন ব্লক করা শিখতে হবে। যেমন- কেউ সিগারেট ছাড়তে চাইলে যদি এই পদ্ধতি অনুসরণ করে যে, গতকাল ১০ টা খেয়েছি, আজকে ৫ টা খেয়ে অভ্যাস কমিয়ে ফেলবো, তাহলে সবচেয়ে প্রবল সম্ভাবনা এই যে সিগারেট ছাড়া সেই ব্যাক্তির পক্ষে সম্ভব হবে না। সিগারেট খাওয়া ছাড়তে চাইলে সিগারেট খাওয়ার সব অপশন বন্ধ করতে হবে। যে মুহুর্তে আপনার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করবে, যে জায়গায় গেলে সিগারেট খেতে মন চাইবে ওসব জায়গা এড়িয়ে চলবেন। সিগারেট নিজে কিনার চেষ্টাই করবেন না৷ নিজেকে সিগারেটমুক্ত ভাবার অপশন দিতে হবে। যদি সিগারেট খাওয়ার সুযোগ রেখেই ভাবেন ছেড়ে দিতে পারবেন, সেটা ভুল সিদ্ধান্ত ছাড়া সঠিক কিছু হবে না।
৬। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজেকে সময় দিন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবেই এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, একটা ভুল সিদ্ধান্তের প্রভাবে আরো অনেকগুলো ভুল করার আগে নিজেকে খানিকটা সময় দিন। জটিল সিদ্ধান্তগুলো দিনের বেলা, বিশেষ করে সকালে নেয়ার চেষ্টা করেন, যখন আপনার মন সবচেয়ে বেশি ফ্রেশ থাকে সচরাচর। ইমোশন থেকে সিদ্ধান্ত না নেয়াই ভাল।
একটা সিদ্ধান্ত দুইভাবে নেয়া যায়, দুইটি ভিন্ন সিদ্ধান্তের দুইরকম কনসিকুয়েন্স হয়। আপনি ভাবতেও পারবেন না একটা সামান্য সিদ্ধান্তও আপনার জীবনকে কতটা বদলে দিতে পারে৷ তাই, সিদ্ধান্তহীনতায় যদি ভুগেন, তাহলে অপেক্ষা করেন, আপনার কিছুই না একটা ফ্রেশ রিস্টার্ট দরকার! একটা নতুন ফ্রেশ সিদ্ধান্ত, অনেক কিছুই বদলে পারে, গোটা জীবনটাই। হতে পারে সেই সিদ্ধান্তটা হলো, আজ থেকে কোনো সিদ্ধান্তই আর না নেয়া (মনের বিরুদ্ধে)!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন