বোরখা পরে তিনি ছুটে চলেন, কাঁধে জীবাণুনাশকের বোতল, হাতে স্প্রে। মসজিদ-মন্দির-গুরদুয়ারা, প্রতিটা জায়গায় তিনি জীবাণুনাশক ছিটিয়ে যান, নিরাপদ রাখেন ধর্মীয় উপাসনালয়কে। অসাম্প্রদায়কতার চমৎকার সব গল্প লেখা হয় ইমরানার হাত ধরে...

উত্তর দিল্লির নেহেরু বিহার এলাকা। এখানেই দেখা মিলবে ইমরানা সাইফি'র। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা, ছুটে চলেছেন বিরতিহীন। পিঠে মাঝারি সাইজের একটা জারের ভেতর জীবাণুনাশক তরল, হাতে স্প্রে। সেটা তিনি ছিটিয়ে চলেছেন স্থানীয় মন্দির, মসজিদ, গীর্জা আর গুরদুয়ারাতে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো জীবাণুমুক্ত করে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তাকে কেউ দেয়নি, নিজেই এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন বত্রিশ বছরের ইমরানা। তিনি মুসলমান, তার কাছে মসজিদের স্থান সবার আগে হবার কথা। কিন্ত সব ধর্মের উপাসনার স্থানকেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন ইমরানা, তার কাছে মসজিদ-মন্দির আর গুরুদুয়ারা এখন এক হয়ে গেছে, সব জায়গাতেই তো স্রষ্টার বাস! 

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো- এই বাংলা প্রবাদটা খুব জনপ্রিয়। ইমরানা সাইফি যেটা করছেন, সেটাকেও মোষ তাড়ানোর মতোই মনে হবে অনেকের কাছে। সংসারের অবস্থা ভালো না, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পয়ঃনিষ্কাশন কর্মী, খুব অল্প টাকা আয়। তার ওপরে লকডাউন শুরু হবার পর থেকে আয়-রোজগার প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। বিপদের এই দিনেও সংসার সামলে ঠিকই বাইরে ছুটেছেন ইমরানা, করোনার ভয়াল থাবা থেকে নিজের এলাকা আর এলাকার মানুষকে বাঁচানোর জন্যে।

এই কাজের জন্যে কোন বেতন পান না ইমরানা। স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন তারা। কয়েকজন মিলে একটা দল গঠন করেছেন, এলাকার সীমা ভাগ করে প্রতিদিন সকালে তারা বেরিয়ে পড়েন, পিঠে থাকে জীবাণুনাশক কেমিক্যাল, হাতে স্প্রে। ইমরানা নিজেই যেচে দায়িত্ব নিয়েছেন মসজিদ-মন্দিরে জীবাণুনাশক ছিটানোর। নারী হওয়ায় প্রতিকূল কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না- এমন ভাবনা থেকেই তাকে দেয়া হয়েছিল এই দায়িত্ব। 

নেহেরু বিহার এলাকার মন্দিরের পূজারী, গীর্জার ফাদার বা মসজিদের ইমাম- সবাই গত কয়েকদিনে ইমরানার ভক্ত হয়ে গেছেন, ভদ্রমহিলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তারা। পূজার সময়টায় মন্দিরে রোজ অল্পস্বল্প মানুষ আসেন, করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি তো থাকেই। ইমরানা খেয়াল রাখেন, পূজা দিতে আসা মানুষগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকছে কিনা। সবাই চলে গেলে স্প্রে থেকে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করেন তিনি। 

রমজান মাস শুরু হয়েছে, মুসলমানদের জন্যে পবিত্র একটা মাস। সারাদিন না খেয়ে রোজা রেখে শরীর ক্লান্ত হয়ে থাকে, সেই ক্লান্ত শরীর নিয়েও কাজে ফাঁকি দেয়ার কথা মাথায় আসে না ইমরানার। প্রতিদিনকার এই রুটিনে ছন্দপতন ঘটে না, বোরখাটা গায়ে চাপিয়ে তিনি ছুটে চলেন। নেকাবের আড়ালে মুখ ঢাকা থাকে, চেহারা চেনা যায় না, কিন্ত তার বোরখাটা দেখলেই মন্দিরের পূজারী থেকে মসজিদের ইমাম- সবাই বুঝে যান, ইমরানা এসেছেন। 

ইমরানা সাইফি ছুটে চলেন...

কখনও কখনও কাজ করতে গিয়ে নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে যায়, বাসায় এসে ক্বাজা নামাজ পড়ে নেন ইমরানা। কিন্ত এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র খেদ নেই তার মনের ভেতরে। ইমরানা জানেন, তিনি মানুষের জন্য কাজ করছেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই এই কাজের বিনিময়ে পরকালে তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন! ঘরে চুলো জ্বলে না কোন কোন দিন, আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়, তবুও মানবসেবার এই ভূত ইমরানার মাথা থেকে নামে না একবারের জন্যেও। 

বাসার কাজ ও তিন সন্তানের দেখাশোনার পরে ইমরানা যতটুকু সময় পান, পুরোটাই ব্যয় করেন এই কাজে। ইমরানা বলছিলেন, ‘এই বিপজ্জনক রোগটা সম্পর্কে মানুষ খুব সচেতন। একারণে স্যানিটাইজেশন কাজ করতে গিয়ে আমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। এই মহামারি আমাদের সবাইকে এক করেছে। আশা করি এটা বজায় থাকবে, আমরা কখনও আলাদা হবো না।’

ইমরানা যে পথ দিয়ে রোজ হেঁটে যান, তিন মাস আগে এই রাস্তাগুলোই রঞ্জিত হয়েছিল মানুষের রক্তে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প জ্বলে উঠেছিল দিল্লিজুড়ে। ইমরানের অনেক আত্মীয়-স্বজনের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকেই, শুধু মুসলমান হবার 'অপরাধে'। ইমরানাও হুমকি পেয়েছেন, নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে যখন শাহীনবাগে জড়ী হয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন, তখন এলাকার কট্টরপন্থীরা গালমন্দ করেছে তাকে, এলাকাছাড়া করার হুমকি দিয়েছে। 

এখন সেই লোকগুলোর বাড়িঘরেই জীবাণুনাশক ছিটিয়ে আসেন ইমরানা, তাদের মন্দির করোনার হাত থেকে নিরাপদে থাকে ইমরানার কারণে। জাফরাবাদ, মুস্তফাবাদ, নেহেরু বিহার হয়ে শিব বিহার থেকে বাবুনগর- ইমরানা সাইফি ছুটে চলেন বোরখা গায়ে, পিঠে কেমিক্যালের ক্যান চাপিয়ে। জীবাণুনাশক ছিটিয়ে করোনাভাইরাস ধ্বংস করছেন তিনি, এভাবে যদি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পকেও ধ্বংস করা যেতো কোন রাসায়নিক ছিটিয়ে, কতোই না ভালো হতো! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা